নিউজ ডেস্ক: আগামী বছর বিধানসভা ভোট। তাই এখন থেকেই প্রস্তুতির তোড়জোড় শুরু করেছে সমস্ত রাজনৈতিক দল। একুশের ফলাফল থেকে শিক্ষা নিয়ে ছাব্বিশ নিয়ে বোধহয় বেশিই সতর্ক বিজেপি। আরও ভালো ফল করতে আগে থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছে গেরুয়া শিবির। আগামী ২৯ মে আলিপুরদুয়ারে জনসভা ও প্রশাসনিক বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এর দু’দিন পর, ৩১ মে রাতে কলকাতায় পা রাখতে পারেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। দলীয় সূত্রে জল্পনা, আগামী ১ জুন দিনভর তিনি একাধিক বৈঠকে ব্যস্ত থাকবেন। এরপর ১ জুন রাত বা ২ জুন সকালে ফের দিল্লির উদ্দেশে উড়ে যাবেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, সর্বভারতীয় সভাপতি থাকাকালীনই এ রাজ্যের দলীয় সংগঠনের হালহকিকত দেখতেন শাহ। এখন সভাপতি না থাকলেও বঙ্গের দলীয় সংগঠনে কড়া দৃষ্টি রয়েছে তাঁর। সাযুজ্য রেখেই নিউটাউনের হোটেলে অনুষ্ঠিত হওয়া সাংগঠনিক বৈঠকে কতটা ভোট-কৌশল বাতলে দেন মোদী-সেনাপতি, সেদিকেই নজর রয়েছে রাজনীতির কারবারিদের।
মাস কয়েক আগে একাধিকবার স্থির হয়েও শেষ পর্যন্ত অমিত শাহের বঙ্গ সফর স্থগিত হয়েছিল। তাই এবারের সফর নিয়ে নির্দিষ্ট করে এখনই বিজেপি নেতৃত্ব কিছু বলতে নারাজ। বছর ঘুরলেই বিধানসভা ভোট। উত্তরবঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর পরে একদিনের ব্যবধানে দক্ষিণবঙ্গে অমিত শাহের কর্মসূচি। গোটা রাজ্যেই পদ্ম ফোটানোই তাঁদের লক্ষ্য।
ছাব্বিশের ভোটে নজর গেরুয়া শিবিরের
মনে করা হচ্ছে, ছাব্বিশের বিধানসভা ভোটের আগে দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে একপ্রস্ত বৈঠকে নির্বাচন স্ট্র্যাটেজি আলোচনা করবেন অমিত শাহ। যদিও সবটাই রয়েছে জল্পনার স্তরে। অমিত শাহর কর্মসূচি সম্পর্কে এখনও নিশ্চিতভাবে কিছু জানানো হয়নি বঙ্গ বিজেপি সূত্রে। তবে জানা গিয়েছে, আগামী ২৬ মে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বিধানসভার পরিষদীয় দলের বৈঠক ডেকেছেন। সেখানে মোদী-শাহর সফর নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনা বেশি।
বিজেপি সূত্রে খবর, ৩১ তারিখ রাতে দিল্লি থেকে দমদম বিমানবন্দরে নামবেন অমিত শাহ। ১ তারিখ ম্যারাথন কর্মসূচি রয়েছে তাঁর। সায়েন্স সিটিতে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন তিনি। সাংসদ, বিধায়কদের সঙ্গে একটি বৈঠক করবেন। এছাড়া কর্মকর্তাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের সম্ভাবনা।
উত্তরবঙ্গ সফরে প্রধানমন্ত্রী
তবে অমিত শাহর বঙ্গ সফরের আগে উত্তরবঙ্গ সফরে আসতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মঙ্গলবার দুপুরে আলিপুরদুয়ারের বিজেপি সাংসদ মনোজ টিজ্ঞা জানান, আগামী ২৯ মে আলিপুরদুয়ার প্যারেড গ্রাউন্ডে জনসভা করবেন প্রধানমন্ত্রী।
নির্বাচনের আগে মোদীর বঙ্গ-সফর যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ
ছাব্বিশের ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রীর এই সফর বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হতে এখনও বেশ খানিকটা দেরি। তার আগে প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের কারণ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। বিশেষত ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং ভারত-পাক সামরিক সংঘাতের পর প্রধানমন্ত্রীর এই বঙ্গ-সফর তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে এই সফর আরও গুরুত্ব পেয়েছে। ভারতের আমদানি সীমাবদ্ধ করার সিদ্ধান্তের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান মোহাম্মদ ইউনূসের ” সেভেন সিস্টার্স ” সম্পর্কে একটি মন্তব্য ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের নাজুক প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। স্থানীয় বিজেপি নেতাদের মতে, এই সংবেদনশীল অঞ্চলে প্রধানমন্ত্রীর সফরের যথেষ্ট ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য থাকবে।
আগামী বছর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সাধারণ নির্বাচন এবং উত্তরবঙ্গে বিজেপির শক্তিশালী অবস্থান বজায় রাখার কারণে, প্রধানমন্ত্রী মোদীর এই সফর দলের আঞ্চলিক কর্মীদের আরও উজ্জীবিত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দার্জিলিং, আলিপুরদুয়ার এবং বালুরঘাট সহ উত্তরবঙ্গের গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলি বিজেপি জিতেছিল। তবে, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী জন বার্লার তৃণমূল কংগ্রেসে (টিএমসি) যোগদানকে একটি ধাক্কা হিসেবে দেখা হয়েছিল। যদিও দলের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা বিশ্বাস করেন যে প্রধানমন্ত্রীর একটি সফর এবং সমাবেশ বাংলায় বিজেপির মনোবলকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলবে এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে তার উপস্থিতি আরও জোরদার করবে।
অপারেশন সিঁদুরের পর প্রথম রাজ্য সফর
পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার জবাব দিয়েছে ভারত। গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ের বৈসরনে পর্যটকদের উপর হামলা চালিয়ে ২৬ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। বেছে বেছে নিরীহ হিন্দু পর্যটকদের উপর হামলা চালানো হয়। ঘটনার পরেই হামলাকারী ও ষড়যন্ত্রীরা ছাড়া পাবে না বলে কড়া বার্তা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেই অনুযায়ী পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ৯টি জায়গায় আঘাত হানে ভারতীয় সেনা। জঙ্গিঘাঁটিগুলি লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়। এরপর প্রত্যাঘাত করতে ভারতের ১৫টি সেনা ছাউনিতে এই হামলা করার ছক কষেছিল পাকিস্তান। এর মধ্যে রয়েছে শ্রীনগর, জম্মু, অবন্তীপুরা। আছে পাঠানকোট, অমৃতসর, লুধিয়ানা, চণ্ডীগড়, কপুরথলা, আদমপুর, ভাতিন্ডা, ফালোড়ি, উত্তারলাই ও ভূজ। অর্থাৎ, কাশ্মীর, পাঞ্জাব, রাজস্থান থেকে গুজরাট—ভারতের উত্তর ও পশ্চিমপ্রান্তে যেসব সেনা ছাউনি আছে, সেগুলিকে লক্ষ্য করে আঘাত হানার ছক কষেছিল পাকিস্তান। কিন্তু আগাম সতর্ক থাকায় তা বানচাল করে দিয়েছে ভারতীয় সেনা। পাকিস্তান যে ড্রোন এবং মিসাইলগুলি দিয়ে হামলা চালানোর চেষ্টা করেছিল, সেগুলি কার্যত ধ্বংস হয়েছে ভারতের সুদর্শন চক্রের প্রভাবে। এত বড় সাফল্যের পরে এটাই প্রধানমন্ত্রী ও অমীত শাহর প্রস্থম বঙ্গ সফর। তাই বঙ্গে এসে তাঁরা কী বার্তা দেবেন সেদিকেই নজর সকলের।
২০২৬-র ভোটের আগে কী বার্তা?
অন্যদিকে অনেকেই বলছেন, ছাব্বিশের ভোটকে পাখির চোখ করে, বৃহস্পতিবার রাজ্যে আসছেন নরেন্দ্র মোদী। আলিপুরদুয়ারে প্রশাসনিক বৈঠক ও রাজনৈতিক সভা করবেন তিনি। এরপর ৩১ মে, দুদিনের সফরে রাজ্যে আসবেন অমিত শাহ। অর্থাৎ বিজেপির দুই শীর্ষ নেতার পরপর পশ্চিমবঙ্গ সফর। নজরে কি বঙ্গ বিধানসভা ভোট? এখন থেকেই কি সুর বেধে দিতে আসছেন বিজেপির দুই মহারথী?
বিজেপির সূত্রে খবর, কয়েক মাস পরেই বঙ্গে বিধানসভা ভোট, তার আগে প্রতিমাসে মোদী-শাহ-নাড্ডার একটি করে জনসভার জন্য আবেদন জানানো হয়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে।
যদিও এ প্রসঙ্গে তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলেন, “ভোট আসলেই মোদী-শাহ বেশি আসেন। এরা রাজনৈতিক পর্যটকের ভূমিকা নিয়ে নেন৷ এর আগেও এরা নিয়মিত এসেছেন। ২০২১,২০২৩,২০২৪ এসেছেন। তারা আসার পরেও বিজেপি হেরেছে৷ আমাদের কথা খালি হাতে আসছেন কেন? বাংলার টাকা বকেয়া। ৩৭০০ কোটি টাকা মমতা বন্দোপাধ্যায় নিজের তহবিল থেকে টাকা দিয়েছেন৷ খালি হাতে শুধু কথা বলতে আসবেন না৷” অন্যদিকে কুনাল ঘোষের এই মন্তব্যের পর রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “তাদের আসার সঙ্গে বিধানসভা ভোটের সম্পর্ক নেই। তবে সরকারি কাজে তারা আসছেন। মোদীজি জনসভা করবেন।”
উল্লেখ্য, এই মুহূর্তে তিন দিনের উত্তরবঙ্গ সফরে রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী ও অমিত শাহর বঙ্গে আসার খবরে জোর চর্চা শুরু হয়েছে রাজ্যে। অন্যদিকে, বর্তমানে রাজ্যে একাধিক সংবেদনশীল ইস্যু— মুর্শিদাবাদে অশান্তি, ওয়াকফ আইনের বিরোধিতা, ২৬ হাজার শিক্ষক-কর্মীর চাকরি বাতিল, ইত্যাদি নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে মোদীর সফর নতুন রাজনৈতিক বার্তা বহন করতে পারে।
মুর্শিদাবাদে অশান্তি
সম্প্রতি ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদে তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয় রাজ্যের নানা প্রান্তে। সুতি থেকে জঙ্গিপুর, আমতলা থেকে ধুলিয়ান। গুলি-বোমাবাজি তো আছেই, সঙ্গে দিকে দিকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল গাড়ি। অশান্তির আবহে শুধু মুর্শিদাবাদেই গুলিবিদ্ধ হয় ৪ জন। দফায় দফায় অশান্ত হয়ে ওঠে জঙ্গিপুর এলাকা। পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথরবৃষ্টি, পুলিশের গাড়িতে আগুন লাগানো থেকে শুরু করে বাইক ভাঙচুর— একাধিক ঘটনায় অশান্তি ছড়িয়েছিল শাজুরমোড় ও ধুলিয়ান সংলগ্ন এলাকাতেও।
এরপর অশান্ত এলাকায় শান্তি ফেরাতে তৎপর হয় কলকাতা হাই কোর্ট। আদালতের নির্দেশেই মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন এলাকায় মোতায়েন হয় কেন্দ্রীয় বাহিনী। তবে ওয়াকফ সংশোধনী আইন বাতিলের দাবিতে মুর্শিদাবাদের অশান্তির কারণ কি শুধু রাজনৈতিক ইন্ধন, নাকি এর পিছনে ওয়াকফ সম্পত্তি বেহাত হওয়ার ক্ষোভও জড়িয়ে রয়েছে, বর্তমানে এই প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে। প্রশাসন সূত্রের দাবি, মুর্শিদাবাদে মোট ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার। এই সম্পত্তির বেশির ভাগটাই কৃষিজমি। তবে তার মধ্যে সাড়ে পাঁচশোটি বেদখল হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। স্থানীয় স্তরে ‘প্রভাবশালীরা’ সে সম্পত্তি দখলে রেখেছেন, অভিযোগ এমনই।
উল্লেখ্য, মুর্শিদাবাদের এই ঘটনাতেও মুখ্যমন্ত্রী দোষ চাপিয়েছেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিএসএফের উপর। তবে বিজেপিকে দোষারোপ করে কি তিনি দায় এড়াতে পারেন? পুলিশ মন্ত্রী হয়ে পুরো ঘটনা কি এড়িয়ে যেতে পারেন তিনি? বাংলার বাতাসে এই প্রশ্নগুলোই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে কিছুদিন হল সবটা স্থিত হয়েছে, শান্ত হয়েছে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি, এমত অবস্থায় এবার রাজ্যে আসছে বিজেপির দুই মহারথী।
২৬ হাজার শিক্ষক-কর্মীর চাকরি বাতিল
অন্যদিকে আবার এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলা। এসএসসি-র শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট। সম্প্রতি ২০১৬ সালের শিক্ষক নিয়োগের পুরো প্যানেল বাতিল করেছে সুপ্রিম কোর্ট। সেই সঙ্গে ২৬ হাজার চাকরি বাতিল করে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার বেঞ্চ জানিয়েছিল, তিন মাসের মধ্যে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। পাশাপাশি, কলকাতা হাই কোর্টের রায় বহাল রেখে নিয়ম বহির্ভূতদের বেতন ফেরত দিতে হবে বলেও নির্দেশ দিয়েছিল প্রধান বিচারপতি খান্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চ। এরপর জল গড়িয়েছে অনেকদূর। পথে নেমেছেন চাকরিহারা শিক্ষক শিক্ষিকারা।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের এসএসসি-র শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। কলকাতা হাইকোর্ট এই সংক্রান্ত শুনানির পর ২০১৬ সালের সম্পূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়াই বাতিল করে দিয়েছিল। এর ফলে ২৫,৭৫৩ জনের চাকরি যায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি শীর্ষ আদালতে শেষ হয়েছিল এই মামলার শুনানি। এরপর রায় ঘোষণা করে ২০১৬ সালের শিক্ষক নিয়োগের পুরো প্যানেলটাই বাতিল করেছে সুপ্রিম কোর্ট। এমত অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী ও অমিত শাহর রাজ্য সফর যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।