নিউজ ডেস্ক: কেন্দ্রের শিক্ষা সংক্রান্ত রিপোর্টে প্রথম স্থান দখল করল পশ্চিমবঙ্গ। তবে এই ছবি আশাব্যঞ্জক নয়। বরং এর দশা খুবই করুণ। রিপোর্ট জানাচ্ছে, ১ জনও পড়ুয়া নেই, এমন স্কুলের নিরিখে দেশের মধ্যে প্রথম স্থানে পশ্চিমবঙ্গ। তাজ্জব ব্যাপার হলো, এই স্কুলগুলিতে আবার শিক্ষকও আছে। আর সেই সংখ্যাটা মোটেই হেলাফেলার নয়। সবমিলিয়ে ১৫ হাজারের কাছাকাছি। এই ছবিই বলে দিচ্ছে শিক্ষা ক্ষেত্রে কোন ছেলেখেলা চলছে বাংলায়।
রাজ্যে পড়ুয়া শূন্য স্কুল কতগুলি?
কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে একজনও পড়ুয়া নেই, এমন স্কুলের সংখ্যা ৩ হাজারের উপর। স্পষ্ট করে বললে, ৩,২৫৪টি স্কুলে কোনও ছাত্র-ছাত্রী নেই। মোদী সরকারের শিক্ষামন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী, পড়ুয়াহীন সরকারি স্কুলের সংখ্যার নিরিখে সারা দেশের মধ্যে সবার উপরে পশ্চিমবঙ্গ। এই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের পরে রয়েছে আম আদমি পার্টি শাসিত পাঞ্জাব। সেখানে পড়ুয়াহীন সরকারি স্কুলের সংখ্যা ২ হাজার ১৬৭। তৃতীয় স্থানে রয়েছে কংগ্রেসশাসিত তেলেঙ্গানা।
পড়ুয়া নেই, তবু শিক্ষক!
কোনও ছাত্র-ছাত্রী নেই। কিন্তু তবু শিক্ষক আছে। হ্যাঁ, এটাই সত্যি। এই মারাত্মক ছবি উঠে এসেছে কেন্দ্রের রিপোর্টে। দেখা যাচ্ছে, যে ৩ হাজারের উপর স্কুলে পড়ুয়া নেই, সেখানে মোট শিক্ষক আছেন ১৪ হাজার ৬২৭ জন। আবার এমন স্কুল আছে যেখানে মাত্র ১ জন শিক্ষক। পশ্চিমবঙ্গে এই ১ জন করে শিক্ষক আছেন ৬ হাজার ৩৬৬ স্কুলে। কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের রিপোর্টে এই উদ্বেগজনক ছবি ধরা পড়েছে। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে এই ছবিই বলে দিচ্ছে, কেমন বেহাল অবস্থা এরাজ্যের শিক্ষার।
স্কুলছুটের হার
কেন্দ্রের রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি স্কুল থেকে স্কুলছুটের সংখ্যাও উদ্বেগজনক। মাধ্যমিক স্তরে এই স্কুলছুটের হার ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ১২.০১ শতাংশ। তার আগের বছর এই স্কুলছুটের হার ছিল ৫.২ শতাংশ। অর্থাৎ, এক বছরে স্কুল ছুটের হার পশ্চিমবঙ্গে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। স্কুলছুটের তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করেছে বিহার। বাংলার স্থান ১৪ নম্বরে।
উদ্বেগ কোথায়?
উদ্বেগ সর্বত্র। পরিসংখ্যানই বলছে, পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষক বসে বসে মাইনে নিচ্ছে। আবার ৬ হাজারের বেশি স্কুলে মাত্র ১ জন শিক্ষক। এই ছবি প্রমাণ করে, রাজ্য শিক্ষা দফতরে যা ইচ্ছা তাই চলছে। কোনও নজরদারি নেই। যে সব স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকছে বিল্ডিংয়ের পর বিল্ডিং, তার কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে না। আবার কারণ বুঝতে পারলেও, কোনও বিহিত করা হচ্ছে না। পাশাপাশি, যেসব শিক্ষকরা পড়ুয়ার অভাবে বসে বসে মাইনে নিচ্ছেন, তাঁদেরকে এমন স্কুলে পাঠানো হচ্ছে না যেখানে শিক্ষকের অভাব। শিক্ষকের অভাবে সেই সব স্কুলও ধীরে ধীরে এভাবে পড়ুয়া শূন্য হয়ে পড়ছে। বলা চলে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে এভাবেই সরকারি স্কুলগুলি ক্রমশ ভগ্নস্তূপে পরিণত হতে চলেছে।
সমস্যার সমাধান কীভাবে?
সমস্যার সমাধানের আশু সমাধানের পথ খুঁজে পাচ্ছেন না কেউ। কারণ, গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া পুরোপুরি বন্ধ। আবার তৃণমূল সরকারের জমানায় যাঁরা স্কুলে চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে গেছে। আদালতের নির্দেশে চাকরি গেছে প্রায় ২৬ হাজার জনের। এরমধ্যে অনেকেই যোগ্য আছেন। কিন্তু যোগ্য অযোগ্য বাছাইয়ে সরকার ব্যর্থ হওয়ায়, সকলকেই এক ফল ভুগতে হচ্ছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে লজ্জার ছবি
পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রে লজ্জার ছবি প্রকট হয় যেদিন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে দুর্নীতির দায়ে জেলে যেতে হয়। কিন্তু কী কারণে জেলে যেতে হয়? সেই কারণটি আরও লজ্জার। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবীর ২টি ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয় ৫০ কোটি টাকা। উদ্ধার হয় প্রচুর সোনার গহনা। কীভাবে এলো ওই টাকা? গোয়েন্দাদের মতে, এই টাকা চাকরি দুর্নীতির। স্কুলের চাকরি লক্ষ লক্ষ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। আর সেই টাকাই জড়ো করে রাখা ছিল বান্ধবীর ফ্ল্যাটে।
এই অভিযোগে শুধু প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী নন, একে একে জেলে যেতে হয় শিক্ষা দফতরের বহু হোমড়া চোমড়াকে। শতছিদ্র হয়ে বেড়িয়ে আসে শিক্ষা ব্যবস্থার কঙ্কালসার চেহারটা। রাজ্যের লক্ষ লক্ষ যুবক যুবতীদের সঙ্গে যেভাবে প্রতারণার খেলা খেলা হয়েছে, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। চাকরির টোপ দিয়ে কীভাবে কোটি কোটি টাকা তোলা হয়েছে, তার সিন্ডিকেটও অনেকটা ফাঁস হয়ে যায় গোয়েন্দা তদন্তে।
কীভাবে বদলাবে এই পরিস্থিতি?
পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থার যে করুণ ছবি বছরের পর বছর দেখে আসছে রাজ্যবাসী, তার কবে বদল হবে, তার সঠিক দিশা দেখাতে পারছেন না কেউই। স্কুলে পড়ানোর বদলে দিনের পর দিন রাস্তায় বসে থাকছেন যোগ্য শিক্ষকরা। তাঁদের কাউকে পুলিশের লাঠি থেকে লাথি খেতে হচ্ছে, আবার কাউকে শিকার হতে হচ্ছে হেনস্থার। ধৈর্য্য ধরে রাখতে না পেরে, এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কেউ কেউ আবার অবাঞ্ছিত ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছেন। ফলে একটা ক্ষয়িষ্ণু সিস্টেমের শিকার হচ্ছেন সকলে। আর এভাবেই যে রাজ্য থেকে নবজাগরণের সূত্রপাত হয়েছিল, সেই রাজ্যে শুরু হয়েছে শিক্ষার অন্তর্জলী যাত্রা।