নিউজ ডেস্ক: চাকরিহারাদের আন্দোলন এবার হবে দিল্লিমুখী। শিক্ষা দফতরের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিক বৈঠকে বললেন চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা। আন্দোলনকারীদের তরফে প্রতিনিধি হাবিবুল্লা বলেন, “আমরা একাধিক দাবি নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুটা আশ্বস্ত হলেও, আমরা সব প্রশ্নের উত্তর পাইনি। তাই এবার আন্দোলন হবে দিল্লিমুখী।” একইসঙ্গে তিনি বলেন, ”আমাদের আন্দোলনের রূপরেখার পরিবর্তন হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি যে, আমাদের আধিকারিকদের দুর্নীতি যতটা দায়ী এখানে, কোর্টও আমাদের দিকটা দেখেনি। মানবিকতার গ্রাউন্ডে দেখেনি। আমাদের সঙ্গে ন্যায় হয়নি। আমরা মনে করি, আমাদের সঙ্গে ন্যায়প্রতিষ্ঠা হয়নি। যেটা হয়েছে সেটা ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের কাছে ভীষণ কলঙ্কিত একটা বিষয়। তাই, এর পরবর্তী আন্দোলনের অভিমুখ আমরা দিল্লিমুখীও করতে চলেছি। সেটা কীভাবে করব সেটা পরবর্তীকালে জানানো হবে। কোর্টকেও বার্তা দিতে চাইছি, যে রায়টা হয়েছে, সেটা এতগুলো মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে যে ছেলেখেলা হয়েছে …এই বিষয়টা একেবারে হেলাফেলা করার মতো নয়। এই বিষয়টা নিয়ে যে পুনর্বিবেচনার আর্জি করা হয়েছে, সেটা যেন সত্যি সত্যি পুনর্বিবেচনার জায়গায় যায়। কারণ, এটা ছেলেখেলার বিষয় নয়। এতগুলো মানুষের জীবন, এতগুলো মানুষের সংসার, তাদের বাচ্চা …একটা পুরো জেনারেশন ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের রাজ্য তথা দেশবাসীর মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে। এই যে রায়টা হয়ে থাকল সেটা পরবর্তীকালে আমাদের যে ভাই-বোনরা আছে, তাঁরা যখন পরীক্ষা দেবেন, এটাই কিন্তু উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করা হবে।”
প্রসঙ্গত, সোমবার শিক্ষাসচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন চাকরিহারাদের ৬ প্রতিনিধি। বেরিয়েই তাঁরা সাংবাদিকদের মুুখোমুখি হন। কিন্তু বাকি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা না বলে তাঁরা আলোচনার বিষয়ে কথা বলবেন না বলে জানিয়ে দেন। বিকাল সাড়ে চারটেয় বসেন সাংবাদিক বৈঠকে। তখনই স্পষ্ট করে দেন, আন্দোলনের রূপরেখা।
কেন সন্তুষ্ট হতে পারলেন না চাকরিহারা?
এই প্রশ্নের উত্তরে চাকরিহারা শিক্ষকদের প্রতিনিধি বলেন, “আমরা চেয়েছিলাম মুখ্যমন্ত্রী বা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। প্রথমেই তো আমরা সন্তুষ্ট নয়। কারণ, আমাদের তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়নি। আমাদের দেখা হয়েছে সচিবের সঙ্গে। একজন মন্ত্রী যে উত্তরগুলো দিতে পারতেন, ওঁরা পক্ষে সব উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। ওঁর সীমাবদ্ধতা অনুযায়ী উনি যতটা বলার বলেছেন, বলার চেষ্টা করেছেন। সেটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কিন্তু, আমাদের যতগুলো প্রশ্ন তার সব উত্তর ওঁর পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই যাঁদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব, আমরা এখনও তাঁদের সাক্ষাৎ চাইছি। আমরা মনে করি, আমাদের এত প্রশ্নের উত্তর মুখ্যমন্ত্রী বা শিক্ষামন্ত্রীর কাছেই পেতে পারি বলে আমরা মনে করি। আমরা মনে করছি, আমাদের সঙ্গে ন্যায় হয়নি।”
চাকরিহারারাদের বক্তব্য
সম্মিলিতভাবে চাকরিহারারা স্পষ্ট করেছেন, তাঁরা কোনওভাবেই পরীক্ষায় বসবেন না। এটাই তাঁদের আলোচনার মূল বক্তব্য ছিল। সে বিষয়ে কী সরকার কোনও আশ্বাস দিল? প্রশ্নের উত্তরে চাকরিহারা রাকেশ আলম বলেন, “ওনারা আমাদের কথা দিয়েছেন, যে এবিষয়ে আইনি পরামর্শ নেবেন। কিন্তু আশ্বস্ত করতে পারেননি। আমাদের দাবি একটাই পরীক্ষা দেব না। হয় আমাদের নামে দুর্নীতি প্রমাণ করতে হবে, তারপর এই পরীক্ষায় বসব, নইলে আমরা যোগ্যতামানের পরীক্ষা নতুন করে দেব না।”
বঞ্চনার কথা জানিয়ে বাংলার সমস্ত বিধায়ক সাংসদ, বাকি রাজ্যের সাংসদদেরও চিঠি দেবেন চাকরিহারারা। পার্লামেন্টে যাতে তাঁদের বিষয়টি তুলে ধরা হয়, সেটার আবেদন জানাবেন বলেও জানিয়েছেন।
শুরু থেকে শেষ- এসএসসি দুর্নীতি মামলা
কলকাতা হাই কোর্টের রায় বহাল রেখে সম্প্রতি ২০১৬ সালের এসএসসিতে নিয়োগের পুরো প্যানেল বাতিল করেছে সুপ্রিম কোর্ট। যার ফলে প্রায় ২৬ হাজার জনের চাকরি (আদতে ২৫,৭৩৫) চাকরি বাতিল হয়েছে। তবে এই দুর্নীতির শুরু ২০১৬ সালে।
২০১৬তে এসএসসি-তে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এসএসসি-তে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। ওই বছরই ২৭ নভেম্বর ওএমআর শিটে পরীক্ষা নেওয়া হয়। এর দু’বছর পর ২০১৮ সালের ১২ মার্চ প্রকাশ করা হয় চূড়ান্ত প্যানেল। ২৮ অগস্ট প্রকাশিত হয় প্যানেলভুক্ত প্রার্থীদের মেধাতালিকা।
২০১৯ সালে নিয়োগ
এরপর ২০১৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে শিক্ষক হিসাবে চাকরি পান নির্বাচিতেরা। নতুন চাকরি। স্কুলে যাচ্ছিলেন শিক্ষকরা। তবে বিপদ আসে ২০২১ সালে।
২০২১-এ দুর্নীতির অভিযোগ
২০১৬ সালের সেই নিয়োগপ্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০২১ সালে। কলকাতা হাই কোর্টে দায়ের হয় একগুচ্ছ মামলা। অভিযোগ ওঠে, গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি কর্মী, নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগে যথেচ্ছ দুর্নীতি হয়েছে। ২০২১ সালে ওই সংক্রান্ত একটি মামলায় প্রথম সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন হাই কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তার পরের দু’বছরে নিয়োগ দুর্নীতির প্রায় ১০টি মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। সিবিআইয়ের তদন্তের পাশাপাশি ‘বেআইনি নিয়োগ’ বাতিল করারও নির্দেশ দেন প্রাক্তন বিচারপতি।
ওই প্রতিবেদন অনুসারে জানা গিয়েছে, তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্য়ায়ের কিছু রায় স্থগিত করে দিয়েছিল হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডনের ডিভিশন বেঞ্চ। পরে আবার সিঙ্গল বেঞ্চের কিছু রায় বহাল রাখে হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি সুব্রত তালুকদারের ডিভিশন বেঞ্চ। এরপর এই সমস্ত নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে ফের শুরু হল মামলা। সুপ্রিম কোর্টে বিক্ষিপ্তভাবে একের পর এক মামলা হতে থাকে। এরপর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসু ও বিচারপতি বেলা এম ত্রিবেদীর বেঞ্চ জানিয়ে দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি একটা বিশেষ বেঞ্চ গঠন করবেন। সেখানেই এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলার যাবতীয় শুনানি হবে। সেটা ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ। সেই অনুসারে ২০২৪ সালের ১৫ জানুয়ারি বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও বিচারপতি মহম্মদ শব্বদ রশিদির বিশেষ বেঞ্চে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ১৭টি শুনানি হয়েছিল। এরপর ২০২৪ সালের ২২ এপ্রিল ২৮২ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণা করল হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ।
হাইকোর্টের রায়
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল ২০১৬ সালের এই নিয়োগ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪ ও ১৬ ধারা লঙ্ঘনকারী। পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। রায়ে বলা হয়েছিল চাকরি যাবে ২৫, ৭৫৩জনের। ওই মামলায় সিবিআইকে তদন্ত করে তিন মাসের মধ্য়ে নিম্ন আদালতে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট।
সুপ্রিম কোর্টের রায়
হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চের রায় ঘোষণার ৪৮ ঘণ্টা মধ্যে সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল রাজ্য। ২৯শে এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্রের বেঞ্চে মামলাটি শুনানির জন্য ওঠে। পৃথক ভাবে শীর্ষ আদালতে মামলা করে রাজ্যের শিক্ষা দফতর, এসএসসি এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। দফায় দফায় মামলা করেন চাকরিহারারাও।
২০২৪ সালের ৭ মে হাই কোর্টের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট জানায়, এই মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পর বেআইনি ভাবে নিযুক্ত ব্যক্তিদের পুরো বেতন ফেরত দিতে হবে। পাশপাশি, সিবিআই-কে হাই কোর্টের নির্দেশ মেনে বেআইনি ভাবে যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করার ছাড়পত্র দেয় সু্প্রিম কোর্ট। এর পর ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট জানায়, ওই মামলায় প্রধান পাঁচটি পক্ষ— পশ্চিমবঙ্গ সরকার, এসএসসি এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, হাই কোর্টের মূল মামলাকারীরা, হাই কোর্টের নির্দেশে যাঁদের চাকরি বাতিল হয়েছে এবং সিবিআই-এর বক্তব্য শুনবে আদালত।
২০২৫-এ চাকরি বাতিল
সুপ্রিম কোর্টে এই মামলাটি মোট ২০ বার শুনানির জন্য ওঠে। বিভিন্ন পক্ষের প্রায় ৪০০ আইনজীবী মামলায় যোগ দেন। শেষমেশ ২০২৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মামলার শুনানি শেষ হয় প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চে। রায় ঘোষণা স্থগিত রাখে আদালত। সম্প্রতি ওই মামলাতেই রায় ঘোষণা হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার জনের নিয়োগ।
কাদের হাতে অযোগ্যদের নিয়োগ?
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বাংলার প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং শিক্ষাকর্মীর চাকরি গিয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে স্কুল সার্ভিস কমিশনের ২০১৬ সালের সম্পূর্ণ প্যানেল বাতিল করে দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। ২০২২ সাল থেকে এই সংক্রান্ত তদন্ত করছে সিবিআই। আদালতে তারা একাধিক চার্জশিট জমা দিয়েছে। রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়-সহ অনেক ‘প্রভাবশালী’র নাম এসেছে সেই সমস্ত চার্জশিটে (যার প্রতিলিপি আনন্দবাজার ডট কমের কাছে রয়েছে)। চার্জশিটে এসএসসি-র তিন উচ্চপদস্থ কর্তা এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদের এক কর্তার নাম বার বার উল্লেখ করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। তাঁরাই এসএসসি দুর্নীতিতে সিবিআইয়ের ‘চারমূর্তি’। দুর্নীতির বৃহত্তর ষড়যন্ত্রে ‘চারমূর্তি’র প্রত্যক্ষ যোগ ছিল বলে অভিযোগ। ওএমআর শিটের তথ্য নষ্ট থেকে শুরু করে অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ, নম্বরে কারচুপি— এসএসসি মামলায় শুরু থেকেই এই চার জনের বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের অভিযোগ ভূরি ভূরি।
অনেকের মতে, চাকরি বাতিল এবং সেই সংক্রান্ত যে জটিলতা তৈরি হয়েছে, তার মূলে এই চার জন। কারণ, এসএসসি মামলায় একটা বড় অংশে যোগ্য এবং অযোগ্য চাকুরিরতদের আলাদা করা যায়নি। অভিযোগ, উত্তরপত্র নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। সেই কারণেই সম্পূর্ণ প্যানেল বাতিল করেছে আদালত। উত্তরপত্রের তথ্য নষ্টের অভিযোগ রয়েছে মূলত এই ‘চারমূর্তি’র বিরুদ্ধেই। এঁরা হলেন- শান্তিপ্রসাদ সিন্হা, সুবীরেশ ভট্টাচার্য, অশোক সাহা ও কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়।
শান্তিপ্রসাদ সিন্হা- নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এসএসসি-র পরামর্শদাতা পদে ছিলেন শান্তিপ্রসাদ সিন্হা। নবম-দশমের শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত চার্জশিটে সিবিআই জানিয়েছে, দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। ২০২২ সালে তাঁকে গ্রেফতার করে সিবিআই।
সুবীরেশ ভট্টাচার্য-এসএসসি-র চেয়ারম্যান পদে ছিলেন সুবীরেশ ভট্টাচার্য। তাঁর বিরুদ্ধেও বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগ এনেছে সিবিআই। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় সংস্থা।
অশোক সাহা-এসএসসি-র চেয়ারম্যান পদে সুবীরেশের মতো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দায়িত্ব সামলেছেন অশোকও। তাঁর আমলেও দুর্নীতি হয়েছে বলে সিবিআইয়ের অভিযোগ। ২০২২-এর সেপ্টেম্বরে সুবীরেশের সঙ্গেই অশোককেও গ্রেফতার করা হয়।
কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়- এসএসসি-র সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি ছিলেন কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়। নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনিও অযোগ্যদের নিয়োগের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁকেও সিবিআই গ্রেফতার করে ২০২২ সালে।
এই ‘চারমূর্তি’ ছাড়াও চার্জশিটে পর্ণা বোস, প্রসন্ন রায়দের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি ব্যাখ্যা করেছে সিবিআই। উল্লেখ করা হয়েছে প্রসন্নের অধীনে কর্মরত প্রদীপ সিংহ, অযোগ্য প্রার্থী জুঁই দাস, মহম্মদ আজ়াদ আলি মির্জ়া এবং ইমাম মোমিনদের নাম।
শুরু থেকেই এই নিয়োগ নিয়ে একাধিক অভিযোগ উঠতে থাকে। এলাকায় শাসক দলের ঘনিষ্ঠ দালালরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও তার ঘনিষ্ঠ আধিকারিকদের চক্র, শাসক দলের ছোট বড় নেতা এবং এসএসসি আধিকারিকরা এই দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জলিত ছিলেন। পরীক্ষার তিন বছর পর নিয়োগ আসলে ছিল দুর্নীতি সুযোগকে প্রসারিত করার একটি কৌশল।
এরপর সিবিআই তদন্ত শুরু করলে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসতে থাকে। সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পাওয়া, ওএমআর শিটের কারচুপি, মেধা তালিকা পরিবর্তন এবং দুর্নীতিগ্রস্থদের চাকরি দেওয়ার জন্য মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার পর নতুন পদ সৃষ্টি-সবই ছিল দুর্নীতির নমুনা। তদন্ত চলাকালীন ইডির অভিজানে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবীর ফ্ল্যাট থেকে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার এবং পরবর্তীতে এসএসসির একাধিক কর্মকর্তার গ্রেফতারি মামলাটিকে নতুন মাত্রা দেয়। এই পরিস্থিতিতে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ে প্রথমবার পুরো প্যানেল বাতিল হয়।
চাকরিহারা শিক্ষকদের চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি
রাজ্য সরকারকে চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি দিলেন চাকরিহারা শিক্ষকরা। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে বলে সময়সীমা বেঁধে দিলেন। এবার নিজেদের সমস্যা নিয়ে সব সাংসদকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাঁরা। ইমেল করা থেকে শুরু করে চিঠি লিখেও মেলেনি শিক্ষামন্ত্রীর সাক্ষাৎ। তাই শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার দাবি তুলেছেন চাকরিহারা শিক্ষকরা। সেটা না হলে বৃহত্তর আন্দোলন করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন চাকরিহারারা।
হাইকোর্টের কড়া নির্দেশ
অন্যদিকে, আন্দোলনের নামে হিংসা নামিয়ে আনা নিয়ে কলকাতা হাইকোর্ট কড়া নির্দেশ দিয়েছেন চাকরিহারা শিক্ষক–শিক্ষিকাদের। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে বিকাশ ভবনের সামনে থেকে অবস্থান তুলে নেন চাকরিহারা শিক্ষকরা। সেন্ট্রাল পার্ক লাগোয়া বইমেলা প্রাঙ্গণ চত্বরে নতুন করে অবস্থান শুরু করা হবে। এই আন্দোলনের পথ থেকে কোনওভাবেই তাঁরা সরে আসবেন না বলে আজ স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন। আর চাকরি ফেরানোর কী উপায় বের করা যায় সেটা নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠকের বিষয়েও আবেদন জানান তাঁরা। এ প্রসঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের এক প্রতিনিধি বলেন, ‘আমরা শেষ ১৬ দিন ধরে শান্তিপূর্ণ অবস্থান করছি। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী বা অন্য কোনও মন্ত্রী আমাদের সঙ্গে দেখা করেননি। আমরা সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তারপর সদুত্তর না পেলে বৃহত্তর আন্দোলনের পথে যাব।’ যদিও এরপরেই শিক্ষা দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক হয় চাকরিহারাদের।
দিনের পর দিন চাকরিহারাদের মিছিল-বিক্ষোভ
সুপ্রিম কোর্ট এসএসসির ২০১৬ সালের পরীক্ষার পুরো প্যানেল বাতিল করে দিয়েছে। আদালতের রায়ের পর থেকেই চলছে আন্দোলন। সম্প্রতি চাকরিহারা ‘অযোগ্য’ শিক্ষকদের আন্দোলনে অবরুদ্ধ হয় হাজরা মোড়। মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের দাবি করে এ দিন মিছিল করেন ‘অযোগ্য’ শিক্ষকরা। হাজরা মোড়ে গিয়ে বসে পড়েন তাঁরা। পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু হয় আন্দোলনকারীদের। চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয় হাজরা মোড়ে। রাস্তা অবরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে কলেজ-অফিস যাত্রীদের দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয়।
বিক্ষোভে সামিল চাকরিহারারা
অন্যদিকে চাকরিহারা শিক্ষকদের বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে দিনভর বিকাশ ভবনের সামনে উত্তেজনা ছড়ায়। সম্প্রতি বিকাশ ভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। সকাল থেকেই চলে এই বিক্ষোভ অভিযান। মাঝে বিধাননগর পুরসভার চেয়ারম্যান সব্যসাচী দত্ত যাওয়ার পর উত্তেজনা আরও বাড়তে থাকে। চাকরিহারা শিক্ষকরা দাবি করেন, সব্যসাচীর অনুগামীরা এ দিন পুলিশের সামনেই আন্দোলনকারীদের মারধর করেন। একাধিক শিক্ষক আহত হয়েছেন। রক্ত ঝরে শিক্ষকদের।
পুলিশের সামনেই বিক্ষোভকারী চাকরিহারারা ব্যারিকেড ভেঙে ফেলেছে বলে অভিযোগ। বসে পড়েছেন বিকাশ ভবনের সামনে। পাল্টা পুলিশের বিরুদ্ধে পাল্টা ক্ষোভ উগরে দিয়ে বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য, ‘আমরা যোগ্য চাকরিপ্রার্থী। মুখ্যমন্ত্রীর পুলিশ আমাদের গায়ে হাত তুলেছে। উনি কেন আসছেন না? পুলিশমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে এর দায় নিতে হবে।’ বিকাশ ভবনে যেতে কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন চাকরিহারাদের। এমনকি চাকরি ফেরাতে সল্টলেকে এসএসসি অফিস আচার্য সদনের সামনে ধর্নায়ও বসে চাকরিহারা শিক্ষক–শিক্ষিকারা।
আন্দোলনকারীদের দাবি
আন্দোলনকারীদের দাবি, আদালতে ওএমআর-এ কারচুপির বিষয়টি এখনই প্রমাণিত হয়নি। ফলত, ওএমআর-এ সমস্যা থাকার জন্য তাঁদের কেন ‘অযোগ্য’ বলা হবে, সেই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। আন্দোলনকারীদের মধ্যে এক শিক্ষক বলেন, ‘আদালতে সিবিআই আমাদের অযোগ্য বলে প্রমাণ করতে পারেনি। তা হলে এসএসসি আমাদের অযোগ্য কেন বলছে? আমাদের এ ভাবে রাস্তায় কেন বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে?’
নতুন করে আলোচনার কোনও অবকাশ নেই: ব্রাত্য বসু
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এসএসসি বা বিকাশ ভবন অবরোধ করাটা কোনো কাজের কথা নয়। আধিকারিকদের কাজ করতে দেওয়া হোক। ব্রাত্যর কথায়, ‘যাঁরা চিঠি দিয়ে জানাচ্ছেন আমরা মুখ্যমন্ত্রীর উপর ভরসা করতে চাই আমি তাঁদেরকেই বিশ্বাস করব।’ নতুন করে চাকরিহারা শিক্ষকদের সঙ্গে কোনও আলোচনা করা হবে কিনা সে বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আলোচনা যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। নতুন করে আলোচনার কোনো অবকাশ নেই।’
এরপরেই অবস্থানরত শিক্ষকদের উদ্দেশে ব্রাত্য বলেন, ‘আমরা যে আইনি লড়াই লড়ছি সেটার জন্য অপেক্ষা করুন। আমরা যে আইনি পুনর্বিবেচনার জন্য সর্বাত্মক লড়াই করছি আপনাদের ‘পয়েন্ট’গুলো নিয়ে সেটার উপর ভরসা রাখুন। সরকার আপনাদের কাউকেই যোগ্য বা অযোগ্য বলেনি। সরকার তো ভাগাভাগি করতে পারে না। আমরা সার্বিকভাবেই রিভিউ পিটিশন দাখিল করছি। আপনারা অপেক্ষা করুন। সেইসঙ্গে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছেন তা যেন আমরা পালন করতে পারি তার জন্য আমাদের মতোই আপনারা দায়িত্ববান হোন।’ শিক্ষামন্ত্রী জানান, তাঁর অফিস থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল কেন তাঁরা বসে আছেন। কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। সেইসঙ্গে লিখিতভাবে অবস্থানরত শিক্ষকদের থেকে কোনও দাবি তাঁর কাছে আসেনি বলে তিনি জানান। এদিন শিক্ষামন্ত্রী বলেন, চাল ও কাঁকর তিনি আলাদা করে বাছতে যাবেন না। তাঁর কাছে সবাই সমান।
অবস্থানরত শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষামন্ত্রীর আবেদন, ‘এই ধরনের কোনো হঠকারি জায়গা থেকে সরে এসে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করুন।’ ব্রাত্যর কথায়, ‘এটা মাথায় রাখতে হবে চাকরি আমরা দিয়েছিলাম। চাকরি খেতে চেয়েছে অন্য রাজনৈতিক দলগুলি।’
রাজ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে বেহাল দশা
সুপ্রিম রায়দানের পরেই চাকারিহারারা যেমন কান্নায় ভেঙে পড়েছেন, তেমনি রাজ্যের স্কুলগুলিতে পঠনপাঠন নিয়েও উদ্বেগ বেড়েছে শিক্ষা দফতরের। প্রশ্ন উঠেছে পড়ুয়াদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। যদিও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ রয়েছে তিন মাসের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হব। কিন্তু, এই সময়ের মধ্যে রাজ্যের বহু স্কুলে এক ধাক্কায় শিক্ষক সংখ্যা অনেক কমে যাওয়ায় পড়ুয়াদের পড়াশোনায় সমস্যা হতে পারে বলে মনে করছে শিক্ষক মহল।
২৬ হাজার জনের চাকরি বাতিল হওয়ায় রাজ্যের সমস্ত বহু স্কুল সমস্যায় পড়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মুর্শিদাবাদের ফারাক্কা ব্লকের অর্জুনপুর হাই স্কুল । শীর্ষ আদালতের রায়ের ফলে এক ধাক্কায় এই স্কুলে শিক্ষকর সংখ্যা অর্ধেকেরও কম হয়ে গিয়েছে। জানা গিয়েছে, অর্জুনপুর হাই স্কুলে মোট শিক্ষক শিক্ষিকার সংখ্যা হল ৬০ জন। তবে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে গোটা প্যানেল বাতিল হওয়ায় চাকরি হারালেন এই স্কুলের ৩৬ জন শিক্ষক। ফলে বর্তমানে এই স্কুলে মোট শিক্ষক শিক্ষিকার সংখ্যা হল নেমে দাঁড়ালো ২৪ জনে। এছাড়াও ৭ জন পার্শ্ব শিক্ষক রয়েছেন এই স্কুলে। স্কুলের মোট পড়ুয়া সংখ্যা হল ১০ হাজার জন। একসঙ্গে এতজন শিক্ষক শিক্ষিকা চলে যাওয়ায় কীভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনা হবে? তা নিয়ে মাথায় হাত স্কুল কর্তৃপক্ষের। প্রসঙ্গত, এই রকম সমস্যা শুধু এই স্কুলেই নয় বরং আরও অনেক স্কুলেই দেখা দিয়েছে।
এছাড়াও রাজ্যের একাধিক সরকারি স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগের পঠনপাঠন চলবে কী ভাবে, তা নিয়ে চিন্তিত স্কুল কর্তৃপক্ষ। এই পরিস্থিতিতে আশু সমাধান খুঁজতে প্রধানশিক্ষকদের তরফ থেকে ফোন যাচ্ছে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের দফতরে। সংসদ সূত্রে খবর, বিজ্ঞান বিভাগ বন্ধ না-করে অস্থায়ী সমাধান হিসাবে কাছাকাছি এলাকায় থাকা তিন-চারটি স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগের পড়ুয়াদের একত্র করে ক্লাস নেওয়ার ‘পরামর্শ’ দেওয়া হয়েছে।
স্কুলে যেতে পারবেন ‘যোগ্য’ শিক্ষকরা
যদিও কয়েকদিন আগেই সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, নবম, দশম, একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস নেওয়ার জন্য আপাতত ‘টেন্টেড’ (অযোগ্য) তালিকায় নাম না-থাকা শিক্ষক-শিক্ষিকারা স্কুলে পড়াতে পারবেন। এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না জানান, শুধুমাত্র ‘যোগ্য’ শিক্ষকরাই আপাতত কাজ চালাতে পারবেন। পড়ুয়াদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই আদালতের এই সিদ্ধান্ত বলে জানান তিনি।
তবে রাজ্যের জন্য বেশ কিছু শর্তও বেঁধে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। শর্ত হলো, ৩১ মে-র মধ্যে শিক্ষক নিয়োগের নতুন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে এবং ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে রাজ্যকে। ফলে চাকরিহারা যোগ্যদের পুরোপুরি স্বস্তি ফেরার জায়গা নেই বলে মনে করছেন আইনজীবীদের একাংশ। তবে যতদিন তাঁরা ক্লাস করাবেন, সেই সময়ের বেতন পেতে তাঁদের কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয় বলেও জানাচ্ছেন তাঁরা। তবে ‘যোগ্য’ গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি কর্মীরা স্কুলে ফিরতে পারবেন না।