নিউজ ডেস্ক: ক’দিন আগেই অনেক কাঠ পোড়ানোর পরে পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মহাকাশচারী সুনীতা উইলিয়ামস। তাঁকে নিয়ে গর্বিত ভারতীয়রা। এবার মহাকাশ গবেষণায় ভারতীয়দের জন্য আরও এক সুখবর। রাকেশ শর্মার পরে আবারও মহাকাশের পথে আরও এক ভারতীয়। তিনি হলেন শুভাংশু শুক্লা।
৪০ বছর পর আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে ভারতীয় মহাকাশচারী হিসেবে পাড়ি দিতে চলেছেন শুভাংশু শুক্লা। দেশের গর্বের কারণ হতে চলেছেন বায়ুসেনার এই টেস্ট পাইলট। জানা গিয়েছে, আসন্ন অ্যাক্সিওম-৪ (Axiom-4) মহাকাশ অভিযানে তিনি অংশগ্রহণ করতে চলেছেন। ৮ জুন শুরু অভিযান। তাই এবার শুভাংশু শুরু করেছেন অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি। যার অংশ হিসেবে ‘প্রি-লঞ্চ’ কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন তিনি।
৪০ বছর পর ঘটবে এই মানব মহাকাশ ভ্রমণ
১৯৮৪ সালের ৩ এপ্রিল, ‘সোভিয়েত ইন্টারকসমস’ প্রোগ্রামের অধীনে, সয়ুজ টি-১১ মহাকাশযানে চড়ে মহাকাশে গিয়েছিলেন ভারতীয় বায়ুসেনার প্রাক্তন পাইলট, উইং কমান্ডার রাকেশ শর্মা। এখনও পর্যন্ত তিনিই একমাত্র ভারতীয়, যিনি মহাকাশে পা রেখেছেন। আর তার ৪০ বছর পর দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে মহাকাশে পা রাখতে চলেছেন, ভারতীয় বায়ুসেনার আরও এক অফিসার, গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভাংশু শুক্ল। তবে ভারতীয় হিসাবে শুভাংশুই প্রথম মহাকাশচারী যে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে মহাকাশ গবেষণার কাজে যাবেন।
নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হবে Ax-4-কে। বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে মহাকাশচারীরা স্পেসএক্স ড্রাগনে চেপে ১৪ দিনেরও ওই মহাজাগতিক সফরে অংশ নেবেন। এই দলেরই অন্যতম শুক্লা। ভারতীয় বায়ুসেনার এই টেস্ট পাইলট গগনযান প্রকল্পেরও একজন। তিনিই প্রথম ভারতীয় মহাকাশচারী যিনি আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে পা রাখবেন। পাইলট হিসেবে এই অভিযানের শরিক তিনি। আপাতত সেই মিশনের জন্যই কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন শুভাংশু।
কেন এই কোয়ারেন্টাইন?
কারণ, মহাকাশে যাত্রার আগে শরীরে কোনও সংক্রমণ ঢুকলে তা মারাত্মক হতে পারে। মহাকাশ স্টেশনের মতো বদ্ধ পরিবেশে সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে, যা শুধু নতুন অভিযাত্রীদের নয়, সেখানে ইতিমধ্যে থাকা নভোচারীদের জন্যও বিপজ্জনক হতে পারে। উপরন্তু, মহাকাশে দীর্ঘদিন থাকার ফলে নভোচরদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটাই কমে যায়। তাই এক্ষেত্রে সতর্কতা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
এই অভিযানে শুভাংশুর সঙ্গী আর কারা?
এই অভিযানে শুভাংশুর সঙ্গে থাকবেন মার্কিন মহাকাশচারী পেগি হুইটসন, যিনি মিশনের কমান্ডার। আরও রয়েছেন ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির দুই মহাকাশচারী — পোল্যান্ডের সাওজ উজনানস্কি-উইসনিয়েস্কি এবং হাঙ্গারির টিবর কাপু। এই অ্যাক্সিওম ৪ মিশনের কমান্ডার হয়েছেন নাসার পেগি হুইস্টন। অ্যাক্সিওম ৪ অভিযানের জন্যে মনোনীত সব নভোচারীরই প্রশংসা করেন কমান্ডার পেগি হুইস্টন। তাঁর কথায়, অভিযানের জন্যে নির্বাচিত সবাই মহাকাশ অভিযানের প্রতি নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। সীমানা ভেদ করে নিজের নিজের দেশের জন্যে আরও নতুন সুযোগ তৈরি করতে তাঁরা সকলেই বদ্ধপরিকর। এখন সব কিছু ঠিকঠাক চললে, শুভাংশু শুক্লার হাত ধরে ভারত আরেকবার মহাকাশ অভিযানের নতুন ইতিহাস লিখতে চলেছে।
কে এই শুভাংশু শুক্লা?
শুভাংশু শুক্লার জন্ম ১৯৮৫ সালের ১০ অক্টোবর। উত্তরপ্রদেশের লখনউতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। প্রায় ১৮ বছর আগে তিনি ভারতীয় বায়ুসেনায় যোগ দিয়েছিলেন। গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুক্লর দিদি জানিয়েছেন, কার্গিল যুদ্ধই ছিল তাঁর বাহিনীতে যোগদানের অনুপ্রেরণা। ১৯৯৯ সালে, কার্গিল যুদ্ধের সময় গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুক্লর বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। কিন্ত, ভারতীয় সেনাদের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের বীরগাথা পড়তে পড়তেই তিনি ঠিক করে নিয়েছিলেন সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দেবেন।
পাইলট হিসেবে শুভাংশু মোট ২০০০ ঘণ্টা আকাশে থেকেছেন। এদিকে গগনযান অভিযানের জন্যে মনোনীত হওয়ার পরে রাশিয়ার ইউরি গ্যাগারিন কসমোনট ট্রেনিং সেন্টারে ১ বছরের বেশি সময় ধরে প্রশিক্ষণ নেন শুভাংশু। ২০০৬ সালে তিনি ভারতীয় বায়ুসেনার অফিসার হিসেবে কমিশন পান। তিনি যুদ্ধবিমানের টেস্ট পাইলট এবং কমব্যাট লিডার। সুখোই-৩০, মিগ ২১, মগ ২৯, জাগুয়ার, হক, ডর্নিয়ার সহ বিভিন্ন ধরনের বিমান চালানোর অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। ২০২৪ সালে শুভাংশু শুক্লাকে ভারতীয় বায়ুসেনার গ্রুপ ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত করা হয়।
২০২৫ সালে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের উদ্দেশে উড়ে যাবে অ্যাক্সিওম ৪ মিশন। এটি একটি প্রাইভেট মিশন হবে। স্পেসএক্স-এর ড্রাগন স্পেসক্রাফটে করে তাঁরা মহাকাশে পাড়ি দেবেন। এই মিশনে অ্যাক্সিওম স্পেস, নাসা, ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ইএসএ) এবং ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো)-র উদ্যোগে ৪ জুন ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ৬.৪১ মিনিটে ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে ড্রাগন মহাকাশযানের সাহায্যে উৎক্ষেপণ হবে৷ কক্ষপথে ডকিং-এর ১৪ দিনের মধ্যে এই মিশনের সময়, নভোচারীরা বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে মাইক্রোগ্রাভিটি গবেষণা এবং প্রযুক্তি প্রদর্শন পরিচালনা-সহ তাঁদের অন্যান্য কার্যক্রম চালাতে পারবেন৷
এই অভিযান নিয়ে কী জানালেন শুভাংশু?
এ প্রসঙ্গে শুভাংশু বলেন, ‘মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে যাওয়ার জন্য সত্যিই উত্তেজিত। সেখানে গিয়ে ভাসতে ভাসতে যোগব্যায়াম করার চেষ্টা করব।’ এরই সঙ্গে শুভাংশু জানান, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল এবং পুরো দেশের প্রতিনিধিত্ব করে, এমন সব সামগ্রী আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন তিনি।
শুভাংশু শুক্লার ক্যাপশন অনুসারে ৭টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে
এটি ৪০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে দ্বিতীয় সরকার-স্পন্সরিত মানব মহাকাশ অভিযান। শুভাংশু শুক্লা মহাকাশে সাতটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালনা করবেন, যার লক্ষ্য ভারতে মাইক্রোগ্রাভিটি গবেষণার প্রচার করা। তারা ২০৩৫ সালের মধ্যে নিজস্ব মহাকাশ স্টেশন তৈরি এবং ২০৪৭ সালের মধ্যে চাঁদে নভোচারী পাঠানোর আশা করছে। ইসরো আইএসএস-এ ভারত-কেন্দ্রিক খাদ্য-কেন্দ্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পরিকল্পনা করেছে, যার মধ্যে রয়েছে মাইক্রোগ্রাভিটি পরিস্থিতিতে মেথি (মেথি) এবং মুগ (সবুজ ছোলা) অঙ্কুরিত করা।
অ্যাক্সিওম-৪ (এক্স-৪) মিশনে ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ইএসএ) প্রকল্পের নভোচারী স্লাভোজ উজনানস্কিও অন্তর্ভুক্ত থাকবেন, যিনি ১৯৭৮ সালের পর দ্বিতীয় পোলিশ নভোচারী হবেন। ১৯৮০ সালের পর টিবর কাপু হবেন দ্বিতীয় হাঙ্গেরিয়ান জাতীয় মহাকাশচারী। পেগি হুইটসন তার দ্বিতীয় বাণিজ্যিক মানব মহাকাশ অভিযানের নেতৃত্ব দেবেন, যা একজন আমেরিকান মহাকাশচারীর দ্বারা মহাকাশে দীর্ঘতম সময় কাটানোর তার স্থায়ী রেকর্ডে যোগ করবে। X-4 ক্রুরা একটি স্পেসএক্স ড্রাগন মহাকাশযানে চড়ে মহাকাশ স্টেশনে ভ্রমণ করবে এবং কক্ষপথ পরীক্ষাগারে ১৪ দিন সময় কাটাবে।
অ্যাক্সিওম-৪ (Axiom-4) মহাকাশ অভিযান কী?
অ্যাক্সিওম-৪ (Axiom-4) হল একটি বেসরকারি মহাকাশ অভিযান, যা অ্যাক্সিওম স্পেস (Axiom Space) দ্বারা পরিচালিত। এই অভিযানটিতে, মহাকাশচারীরা মহাকাশে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গবেষণা পরিচালনা করেন। এর মধ্যে মাইক্রোগ্রাভিটি গবেষণা, প্রযুক্তি প্রদর্শন এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা অন্তর্ভুক্ত। অ্যাক্সিওম স্পেস এর আগে তিনটি অভিযান সম্পন্ন করেছে। এই মিশনগুলি মহাকাশ গবেষণায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে এবং নতুন প্রযুক্তি বিকাশে সহায়তা করে।
এর আগে অ্যাক্সিওম স্পেস যে তিনটি অভিযান চালিয়েছিল আন্তর্জাতিক স্পেস সেন্টারে সেগুলি হল- অ্যাক্সিওম ১, অভিযান শুরু হয়েছিল ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে। সেই অভিযান চলেছিল ১৭ দিন ধরে। অ্যাক্সিওম ২ চলেছিল ২০২৩ সালের মে মাসে এবং অ্যাক্সিও ৩ অভিযান হয়েছিল ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে। এই শেষ অভিযানটি ১৮ দিন ধরে চলেছিল।
কেন এই মিশন গুরুত্বপূর্ণ?
Ax-4 হলো অ্যাক্সিওম স্পেসের চতুর্থ প্রাইভেট স্পেস মিশন, যার প্রধান উদ্দেশ্য মহাকাশে গবেষণা এবং প্রযুক্তিগত পরীক্ষা চালানো। মহাকাশে তাঁরা বিভিন্ন মাইক্রোগ্রাভিটি এক্সপেরিমেন্ট, বায়োলজিক্যাল ও ফিজিক্যাল সায়েন্স, নতুন প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতির পরীক্ষা চালাবেন। পুরো মিশনটি ১৪ দিনের হবে এবং এটি মানবজাতির ভবিষ্যৎ মহাকাশ অভিযানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ডেটা সংগ্রহে সাহায্য করবে।
ভারতের জন্য বড় সাফল্য
প্রসঙ্গত, ভারতের মহাকাশে প্রথম মানুষ পাঠানোর অভিযান, গগনযান মিশন হবে ২০২৬ সালে। তিন দিন ধরে পৃথিবীর কক্ষপথে ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেবেন তিন ভারতীয় নভোশ্চর। তারপর, তাঁদের নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হবে। ভারতীয় জলসীমায় এসে ল্যান্ড করবে তাদের মহাকাশযান।
তাই শুধু একজন নভোচারী পাঠানোই নয়, এই মিশনের মাধ্যমে ভারত দেখাতে চলেছে যে তারা ভবিষ্যতের গগনযান মিশন বা আন্তর্জাতিক সহযোগিতামূলক মহাকাশ প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে তৈরি। শুভাংশু শুক্লার এই যাত্রা ভারতের তরুণ প্রজন্মকে মহাকাশ গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করবে এবং দেশকে বিশ্বমানের গবেষণা ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
জানানো হয়েছে, এই অভিযানের জন্য অগস্টের প্রথম সপ্তাহেই গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুক্ল এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন নায়ারের প্রশিক্ষণ শুরু হবে। এই অভিযানে, তাঁরা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে নির্বাচিত কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং প্রযুক্তিগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। গত বছর, গগনযান মিশনের জন্য ভারতীয় বায়ুসেনার চার পাইলটকে নির্বাচিত মহাকাশ অভিযানের জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। বেঙ্গালুরুর ইসরো-তে এক নভোশ্চর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল।
মে থেকে জুলাইয়ে একগুচ্ছ মিশন ইসরোর
এই গগনযান ছাড়াও সম্প্রতি নয়াদিল্লির বৈঠকে ভারতীয় মহাকাশ সংস্থার আরও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মিশনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামিদিনে ইসরোর বিভিন্ন মিশনের বিষয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে জানিয়েছেন ভারতীয় মহাকাশ সংস্থার চেয়ারম্যান ভি নারায়ণন। তিনি জানিয়েছেন, আগামী মে থেকে জুলাইয়ের মধ্যে ইসরোর যে বড়-বড় মিশন আছে, তার মধ্যে অন্যতম হল পিএসএলভি-সি৬১ মিশন। যে রকেটের পিঠে চাপিয়ে ইওএস-০৯ স্যাটেলাইট পাঠানো হবে।