নিউজ ডেস্ক: অপারেশন সিঁদুর সীমান্তে। আর এতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাজ্য সফরে আসার পরই মমতাকে পাল্টা আসরে নামতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সিঁদুরের প্রসঙ্গ তুলে প্রতিবেশী দেশকে সতর্ক করে দিতে চেয়েছেন। দুর্নীতির প্রশ্নে সমালোচনা করেছেন তৃণমূল সরকারের। আর তার পাল্টা বলতে উঠে সিঁদুর নিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এদিকে, এই অপারেশন সিঁদুরের সাফল্য আর পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী চেহারা তুলে ধরতে দেশে দেশে ঘুরছেন অভিষেক। কেন্দ্রের পাঠানো প্রতিনিধি দলের সদস্য তিনি। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কোন পথে তৃণমূল! অভিষেক না মমতা?
অপারেশন সিঁদুর – কী বললেন মোদী?
অপারেশন সিঁদুরের পর এই প্রথম বাংলা সফরে প্রধানমন্ত্রী। তাই আলিপুরদুয়ারের সভা থেকে এই প্রসঙ্গ উঠে আসা স্বাভাবিকই ছিল। মোদী বলেন, ‘আজ যখন সিঁদুরখেলার এই মাটিতে এসেছি, তখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারতের নতুন ভূমিকার কথা উঠে আসা স্বাভাবিক। আমাদের বোনেদের সিঁদুর ওরা মুছেছিল। আমাদের সেনা সিঁদুরের শক্তি ওদের বুঝিয়ে দিয়েছে। আমরা সন্ত্রাসের ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে দিয়েছি, যা পাকিস্তান কল্পনাও করতে পারেনি।’
১৯৭১ সালের প্রসঙ্গ তুলে এনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকের বাংলাদেশে যে রকম সন্ত্রাস পাকিস্তান করেছিল, পাকিস্তানের সেনা বাংলাদেশে যে পরিমাণে ধর্ষণ আর খুন করেছিল, তা কেউ ভুলতে পারে না। সন্ত্রাস আর নরসংহার পাকিস্তানের সেনার সবচেয়ে বড় দক্ষতা।’
সিঁদুরে মেঘ দেখলেন মমতা?
রাজ্যে এসে অপারেশন সিঁদুর প্রসঙ্গ তুলতেই পাল্টা আক্রমণে নামেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সব নাম কেন্দ্রীয় সরকারই ঠিক করে। অপারেশন সিঁদুর নামটা দেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক ভাবে ক্যাচ করার জন্য। আমি এত দিন কিছু বলিনি। কিন্তু আজ বলতে বাধ্য হলাম।এই নাম দেওয়া হয়েছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে। যে সময় বিজেপির সমর্থকেরাও দেশের হয়ে গলা ফাটাচ্ছেন, সেই সময় নির্বাচনী প্রচারের অংশ হিসাবে এখানে রাজনীতির হোলি খেলতে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী”। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামনের বছরই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোট। ভোটের আগে বিজেপি যাতে অপারেশন সিঁদুর নিয়ে কোনও ডিভিডেন্ড না তুলতে পারে, তার জন্য আগেভাগেই আক্রমণের রাস্তায় হাঁটছেন তৃণমূল নেত্রী। অনেকে বলছেন, এখন থেকেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন তিনি।
মমতা সরকারকে আক্রমণ মোদীর
আলিপুরদুয়ারে এদিন রাজনৈতিক সভার শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী তুলে আনেন মুর্শিদাবাদ-মালদহ প্রসঙ্গ। তৃণমূলের উদ্দেশ্যে তীব্র আক্রমণ শানিয়ে বলেন, ‘মুর্শিদাবাদ-মালদহে যা হয়েছে, তা বর্তমান সরকারের নির্মমতার উদাহরণ। এখানকার সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত। প্রতি বার আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। এভাবে কি কোনও সরকার চলতে পারে?’
রাজ্যের শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়েও মমতা সরকারকে তুলোধনা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।তিনি বলেন, ‘তৃণমূলের নেতাদের দুর্নীতির জন্য এখানকার বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এঁরা নিজেদের ভুল মানতে চাইছেন না। উল্টে আদালতকে আক্রমণ করছেন। তৃণমূল সরকার অভিযুক্তদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে। বিজেপি এটা হতে দেবে না।’
রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দেগে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, ‘কেন্দ্রের অনেক বড় বড় প্রকল্প এই রাজ্যে কার্যকর করা হয়। আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প এখানে চালু হতে দেওয়া হয়নি। এখানকার লোকেরা বাইরে গেলে ওই প্রকল্পের সুবিধা পান না। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার আওতায় পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষ বাড়ি পেতেন। কিন্তু এখানে তাও হতে দেওয়া হল না। ৭০ বছরের ঊর্ধ্বে সবাই স্বাস্থ্য পরিষেবা পেতেন। তা করতে দিল না এখানকার নির্মম সরকার।’
মোদীকে ব্যক্তি আক্রমণে মমতা
রাজ্যে এসে প্রধানমন্ত্রী যখন রাজ্য সরকারের মুখোশ খুলে দিচ্ছেন, তখন নিজের রাগ চেপে রাখতে পারেননি মুখ্যমন্ত্রী। নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে মোদীকে ব্যক্তি আক্রমণই করে বসেন তিনি। বলেন, ‘দেশের হয়ে বিরোধী দলের প্রতিনিধিরা যখন বিদেশে গিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন, তখন আপনি এখানে রাজনীতি করতে এসেছেন? এটা রাজনীতি করার সময়? আপনার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছি। পারলে কালকেই ভোট করুন। দেখিয়ে দেবো।’
সুর আরও চড়িয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথম বার নির্বাচনের আগে বলেছিলেন চা-ওয়ালা। তার পরের বার বললেন, পাহারাদার। আর এখন কি সিঁদুর বেচতে এসেছেন? মনে রাখবেন, সিঁদুর বেচা যায় না। এটা মা-বোনেদের আত্মসম্মান।’ তিনি বলেন, ‘অপারেশন সিঁদুর নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। প্রত্যেক মহিলার সিঁদুরের প্রতি সম্মান রয়েছে। তাঁরা স্বামীদের থেকে সিঁদুর নেন। কিন্তু আপনি তো সকলের স্বামী নন!’ পরক্ষণেই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমি দুঃখিত। এটা আমার বলার কথা ছিল না। কিন্তু আপনি আমাকে বাধ্য করেছেন মুখ খুলতে।’
বিদেশ সফরে অভিষেক
তৃণমূল নেত্রী যখন অপারেশন সিঁদুর নিয়ে মোদীকে আক্রমণ করছেন, সিঁদুর নামকরণ নিয়ে রাজনীতির অভিযোগ তুলছেন, তখন বিদেশ সফরে অপারেশন সিঁদুরের মাহাত্ম্য তুলে ধরছেন দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সর্বদলীয় টিমের হয়ে পাকিস্তানের মুখোশ খুলে দিতে সোচ্চার হয়েছেন অভিষেক। তাঁর সাফ কথা, সাপ সাপই থাকে। পাকিস্তান দশকের পর দশক যেভাবে সন্ত্রাসবাদকে মদত দিয়ে যাচ্ছে, তাতে তাদের দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র ছাড়া আর কিচ্ছু বলা যায় না। এই পশ্চিমবঙ্গ থেকে দুজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিদেশ সফরে সামিল হয়েছেন। বিজেপি থেকে আছেন সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য। আর তৃণমূল থেকে আছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
কোন প্রতিনিধি দলে আছেন অভিষেক?
অভিষেকদের এই প্রতিনিধিদলে রয়েছেন জেডি-ইউ সাংসদ সঞ্জয় ঝা, বিজেপির অপরাজিতা সারঙ্গি, ব্রিজ লালা, প্রধান বড়ুয়া, হেমঙ্গ যোশি এবং সিপিএমের জন ব্রিট্টাস। এ ছাড়া সলমন খুরশিদ এবং মোহন কুমারও রয়েছেন এই প্রতিনিধিদলে। বস্তুত, ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তার পরবর্তী ভারত-পাক সংঘর্ষের পরে ভারতের অবস্থান বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দিতে শাসক-বিরোধী সাংসদদের নিয়ে তৈরি সাতটি প্রতিনিধিদল বিভিন্ন দেশে ঘুরছে। এর আগে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় গিয়েছিলেন অভিষেকরা। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেডি-ইউ সাংসদ সঞ্জয় ঝা।
মোদীর দূত অভিষেক
জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া – যেখানেই গেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, সেখানেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন তিনি। একইসঙ্গে যে ভাষায় তিনি ইসলামাবাদকে আক্রমণ করেছেন, তাদের স্বরূপ তুলে ধরেছেন, তাতে এটা বলাই যায়, মোদীর দূত হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। ইন্দোনেশিয়ার থিঙ্কট্যাঙ্কদের তিনি বলেন, ‘ভারতের অর্থনীতির অগ্রগতিকে রোধ করতে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদকে লালনপালন করছে এর যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। জাপানকে টপকে ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে আমরা তিন নম্বরে পৌঁছে যাব। পাকিস্তান সেখানে আর্থিক সঙ্কটে হিমশিম খাচ্ছে।’
অভিষেক বলেন , ‘গত ৫০ বছরে কত হিংসার ঘটনা ঘটেছে! ২০১৬ সালে আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় গিয়েছিলাম। পাঠানকোট ও উরিতে জঙ্গি হামলা পরে পাকিস্তান যৌথতদন্ত চেয়েছিল। তাদের কল–ডেটা, ভয়েস স্যাম্পল, ডিজিটাল প্রমাণ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।’
অভিষেকের গলায় বিজেপির সুর
ঠিক এই কথাটাই এতদিন বলে আসছিল বিজেপি। বিরোধীরা রাজনীতির স্বার্থেই জলঘোলা করতে চেয়েছিল। উরি থেকে পাঠানকোট হামলা নিয়ে নানা মন্তব্য করেছিল। কিন্তু অভিষেকের এই মন্তব্যের পরই মমতা-অভিষেক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অপারেশন সিঁদুর নিয়ে তৃণমূল কেন এমন দ্বিচারিতা করছে, তাই বুঝতে পারছে না কেউ। অপারেশন সিঁদুরের পর প্রধানমন্ত্রী যেখানেই যাবেন, সেখানেই তা নিয়ে বলবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এসেই তাঁকে পাল্টা কথা শুনতে হয়েছে। আর তা করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, চায়ের পর এবার সিঁদুর বেচছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এটাকে বিক্রি বলে না ভারতের গরিমাকে তুলে ধরা বলে! যে রাজ্যে সিঁদুর খেলা হয়, সেখানে এসে কি প্রধানমন্ত্রী সিঁদুরের মাহাত্ম্য তুলে ধরবেন না! কিন্তু তা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে জ্বালা, তা কি অন্য ইঙ্গিত দিচ্ছে? মোদীর সফরে তিনি কি সিঁদুরে মেঘ দেখছেন ? ২০২৬ এর ভোটের কথা ভেবে তিনি কি চিন্তিত? সিঁদুর যুদ্ধে এই প্রশ্নই এখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।