নিউজ ডেস্ক: অবশেষে প্রায় দশ বছর পর নতুন পরীক্ষা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করল এসএসসি। সরকারি স্কুলে নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির জন্য সহকারী শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করল স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)। গত মঙ্গলবারই নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, সুপ্রিম কোর্ট ৩১ মে-র মধ্যে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করতে বলেছে। ৩০ মে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। সেই মতো শুক্রবার সকালে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে দিল এসএসসি। শেষ পরীক্ষা হয়েছিল ২০১৬ সালে। তার মাঝে অবশ্য আপার প্রাইমারিতে ২০২২ সালে একবার নিয়োগ হয়েছিল।
এরপর সম্প্রতি সুপ্রিম নির্দেশে ২০১৬ সালের পুরো প্যানেলই বাতিল করেছে সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালত রাজ্যকে নির্দেশ দিয়েছে, নতুন করে পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ওই প্যানেলের প্রত্যেককে নতুন করে পরীক্ষায় বসার সুযোগ করে দিতে হবে। যদিও নতুন করে পরীক্ষায় বসতে একেবারেই নারাজ চাকরিহারা।
এবারের পরীক্ষায় কি ফ্রেশার্সরাও বসতে পারবেন?
হ্যাঁ! বরং এবারের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা হবে আরও বহু গুণ বেশি। কারণ গত দশ বছর ধরে যাঁরা বিএড পাশ করে বসে রয়েছেন, তাঁরাও পরীক্ষায় বসতে পারেননি এতদিন। এবার তাঁদেরও সুযোগ। ফলে এই লড়াই অনেকটাই কঠিন।
কারা পরীক্ষায় জন্য আবেদন করবেন?
১) যে সমস্ত ‘যোগ্য’ শিক্ষকেরা সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরি হারিয়েছেন।
২) যারা ১০ বছর ধরে বিএড পাশ করে বসে রয়েছেন।
৩) ফ্রেশার্সরা যারা রয়েছেন তাঁরাও বসতে পারবেন পরীক্ষায়।
বস্তুত, মঙ্গলবারই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, যাঁরা চাকরি করেছেন, কিন্তু এখন আবেদন করার বয়স পেরিয়ে গিয়েছে, এ রকম অনেকে রয়েছেন। তাই চাকরিহারাদের ক্ষেত্রে বয়সে ছাড় দেওয়া হবে। তাঁরা যাতে সকলেই পরীক্ষায় বসতে পারেন, বয়সের জন্য যাতে না-আটকায়, সেই ব্যবস্থা হবে। চাকরিহারারা বয়স পেরিয়ে গেলেও পরীক্ষায় বসতে পারবেন। যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতার জন্য সুবিধা দেওয়া হবে।
শূন্যপদ কত?
বিজ্ঞপ্তি হবে মোট ৪৪,২০৩ শূন্যপদের। নবম-দশমের ক্ষেত্রে ১১৫১৭+১১৬৯৫ = ২৩২১২ ও একাদশ দ্বাদশের ক্ষেত্রে ৬৯১২+৫৬০২=১২৫১৪। অর্থাৎ ৩৫, ৭২৬। সেখানে ২০১৬ সালের প্যানেলের চাকরিহারা শিক্ষক শিক্ষিকাই রয়েছেন ১৯হাজার। অন্যদিকে, গ্রুপ সি ৫৯১+২৩৯৮ = ২৯৮৯ ও গ্রুপ ডি-র ক্ষেত্রে ১০০০+৪৪৮৮ = ৫৪৮৮ শূন্যপদ রয়েছে। তবে আপাতত শিক্ষকপদেই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে চলেছে রাজ্য সরকার।
অনলাইনে আবেদন করা যাবে কবে থেকে?
মঙ্গলবারই মুখ্যমন্ত্রী পরীক্ষার্থীদের আবেদনের সময়সীমা, প্যানেল প্রকাশের সম্ভাব্য সময়সীমা জানিয়ে দিয়েছিলেন। এসএসসির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আগামী ১৬ জুন থেকে অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন পরীক্ষার্থীরা। অনলাইনে আবেদন করার শেষ দিন ১৪ জুলাই। নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির সহকারী শিক্ষক পদের জন্য আবেদন করলে সাধারণ এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (ওবিসি)-র পরীক্ষার্থীদের জমা দিতে হবে ৫০০ টাকা। আর তফসিলি জাতি, উপজাতি, প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীদের দিতে হবে ২০০ টাকা। পরীক্ষায় বসার ফি জমা দিতে হবে ১৪ জুলাই রাত ১২টার আগে।
কবে প্রকাশিত হবে প্যানেল?
লিখিত পরীক্ষার সম্ভাব্য সময় সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। লিখিত পরীক্ষার ফলপ্রকাশ হতে পারে অক্টোবরের চতুর্থ সপ্তাহে। ইন্টারভিউয়ের সম্ভাব্য সময় নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে তৃতীয় সপ্তাহ। প্যানেল প্রকাশিত হবে ২৪ নভেম্বর। কাউন্সেলিং এবং নিয়োগের প্রস্তাব সংক্রান্ত ঘোষণা হতে পারে ২৯ নভেম্বর।
উল্লেখ্য, দুর্নীতির অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এসএসসি-র ২০১৬ সালের সম্পূর্ণ প্যানেল বাতিল হয়ে গিয়েছে। চাকরি গিয়েছে ২৫,৭৩৫ জনের। তাঁদের জন্য রাজ্য সরকারকে নতুন করে নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু করতে বলে শীর্ষ আদালত।
দুর্নীতি ঠেকাতে পরীক্ষাবিধিতে কী কী বদল এল?
১) ওএমআর (OMR) শিটেই হবে পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষে সমস্ত পরীক্ষার্থীকে দেওয়া হবে ওএমআর শিটের কার্বন কপি। যা পরীক্ষার্থীরা বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন।
২) ফেরানো হচ্ছে ইন্টারভিউ বা অ্যাপ্টিটিউড টেস্ট। সমস্তটা ভিডিওগ্রাফি করা হবে।
৩) মডেল উত্তরপত্র আপলোড করা হবে ওয়েবসাইটে।
৪) নম্বর বিভাজনের ক্ষেত্রেও বেশ কিছু জায়গায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
৫) অ্যাকাডেমিক স্কোরের থেকেও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে, কীভাবে একজন শিক্ষক পড়িয়ে দেখাচ্ছেন, ডেমো দেখাচ্ছেন তার ওপর।
৬) শিক্ষক প্রশিক্ষণের ওপরেও কোনও নম্বর থাকে কিনা, সেটাও দেখা হচ্ছে।
অন্যদিকে, ২০১৬ সালের প্যানেলের চাকরিহারাদের এবারের পরীক্ষায় বাড়তি সুযোগ দেওয়া হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেমনটা হলে পাল্টা মামলারও ভয় রয়েছে। যদিও চাকরিহারারা এখনও তাঁদের নিজেদের বক্তব্যে অনড়। তাঁদের বলছেন, ২০১৬ সালে তাঁরা একবার পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু আবার কেন পরীক্ষা? নতুন বিধিতে চাকরিহারারা পরীক্ষা দেন কিনা, সেটাই দেখার।
কোন নিয়মে হবে চাকরিহারাদের পরীক্ষা?
বুধবার মধ্যরাতে পরীক্ষার নয়া বিধি প্রকাশ করে কমিশন। নয়া বিধিতে জোর দেওয়া হয় শিক্ষকতার পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং ক্লাস নেওয়ার দক্ষতার উপরে। জানানো হয়, লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হবে ৬০ নম্বরের। আগে এটি ছিল ৫৫ নম্বরের। শিক্ষাগত যোগ্যতার উপরে থাকবে সর্বোচ্চ ১০ নম্বর। আগে এটি ছিল ৩৫ নম্বর। ইন্টারভিউয়ে ক্ষেত্রে নম্বর আগেও সর্বোচ্চ ১০ ছিল, এখনও তা-ই রাখা হয়েছে। শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার উপর দেওয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ ১০ নম্বর। এ ছাড়া ‘লেকচার ডেমোস্ট্রেশন’-এর জন্যও সর্বোচ্চ ১০ নম্বর রাখা হচ্ছে। শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা এবং ‘লেকচার ডেমোস্ট্রেশন’— দু’টিই নতুন সংযোজিত হয়েছে। এই দু’টি মিলিয়ে সর্বোচ্চ মোট ২০ নম্বর রাখা হয়েছে।
কেউ যদি তার নিজের খাতার ইমেজ কপি দেখতে চান অনলাইনে অর্থের বিনিময় তিনি সেটা করতে পারবেন। প্রত্যেককে লিখিত পরীক্ষায় কাট অফ মার্কস পেতে হবে। কাউন্সিলিং হবে ওয়ান ইসটু ওয়ান পয়েন্ট সিক্স এই অনুপাতে। ওয়েবসাইটে প্রত্যেক ক্যান্ডিডেট ফলপ্রকাশের পরে প্রতি সেক্টরে কত নম্বর পেয়েছেন তা দেখতে পারবেন। কাট অফ মার্কস এবং ফাইনাল নম্বর দেখতে পারবেন।
২০২৫ সালের ১ জানুয়ারির হিসাবে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত নিয়োগের জন্য আবেদন জানাতে পারবেন চাকরিপ্রার্থীরা। এ ছাড়া, তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং অন্য অনগ্রসর শ্রেণির চাকরিপ্রার্থীরা রাজ্য সরকারের নিয়ম অনুসারে বয়সের ঊর্ধ্বসীমায় ছাড় পাবেন।
এছাড়াও নয়া এই বিধিতে বলা হয়েছে, এই মেধাতারিকা এবং ওয়েটিং লিস্ট অর্থাৎ অপেক্ষায়মান মেধাতালিকার মেয়াদ থাকবে প্রথম কাউন্সিলিং থেকে এক বছর ৷ তবে যদি রাজ্য সরকারের থেকে অনুমতি পায়, তাহলে সেই মেয়াদ আরও ছ’মাস বৃদ্ধি করতে পারে কমিশন ৷ ওয়েমার শিট সংরক্ষণ রাখতে হবে দু’বছর। কিন্তু তার স্ক্যান কপি ১০ বছর সংরক্ষিত রাখতে হবে প্যানেল শেষের পর। একইসঙ্গে বলা হয়েছে, কেউ আদালতে দোষী প্রমাণিত হলে, সে যোগ্য বলে বিবেচিত হবে না।
চাকরি হারানো শিক্ষকরা এখনও আন্দোলনে
চাকরি ফিরে পাওয়ার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন আগেই চাকরি হারানো শিক্ষক-শিক্ষিকারা। তাঁদের দাবি, নতুন পরীক্ষা নয়, বরং আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী পুরনোদের চাকরি ফিরিয়ে দিতে হবে। ফলে নতুন এই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হলেও, রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে অস্থিরতা কাটছে না।
চাকরিহারাদের দাবি
আসলে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি এবং নতুন পরীক্ষাবিধিতে আলাদা করে চাকরিহারাদের জন্য কিছু নেই। তাই এই ব্যবস্থায় হতাশ হয়েছেন চাকরিহারা শিক্ষকেরা। শুক্রবার সরকারি স্কুলে নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির জন্য সহকারী শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার আগে নতুন বিধিও প্রকাশিত হয়েছে। নয়া বিধি অনুসারে, প্রার্থীদের শিক্ষকতার পূর্ব অভিজ্ঞতা এবং ক্লাস নেওয়ার দক্ষতার উপরে জোর দেওয়া হয়েছে।‘যোগ্য’ শিক্ষক শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চের কনভেনার মেহবুব মণ্ডলের প্রশ্ন, “সরকার কাদের জন্য পরীক্ষা নিচ্ছে? নোটিফিকেশন দেওয়া হবে, তা পূর্বনির্ধারিত ছিল। তাহলে পরীক্ষার জন্য এত তাড়াহুড়ো কেন করা হচ্ছে?” তাঁর অভিযোগ, সরকার নিজেদের স্বচ্ছ রাখতে পরীক্ষা নিচ্ছে, এতে চাকরিহারাদের কোনও স্বার্থ জড়িয়ে নেই। তিনি আরও বলেন, “আন্দোলন থেকে আমরা সরছি না। দুর্নীতি ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজপথে থেকেই লড়াই জারি থাকবে।” উল্লেখ্য, পরীক্ষার বিরুদ্ধে ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজপথে অর্ধনগ্ন মিছিল করতে চলেছেন চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষকেরা। একইসঙ্গে চাকরিহারা শিক্ষকদের একাংশের আরও অভিযোগ, আলাদা করে চাকরিহারাদের জন্য কিংবা যাঁরা অসুস্থ, তাঁদের জন্য এই নতুন বিজ্ঞপ্তিতে কিছু নেই। এত কম সময়ে এত বড় সিলেবাস শেষ করা প্রায় অসম্ভব। তা ছাড়াও যে সমস্ত ‘যোগ্য’ শিক্ষকেরা পাশ করবেন না, তাঁদের কী হবে, তা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও নির্দেশিকা দেয়নি সরকার। অন্য দিকে, ওবিসি মামলা বিচারাধীন। বহু প্রার্থী আছেন, যাঁরা এই সংরক্ষণে চাকরি পেয়েছিলেন। তাঁদের কী হবে, তা নিয়েও স্পষ্ট করে কিছু উল্লেখ করা নেই বলে চাকরিহারাদের দাবি। তাঁদের প্রশ্ন, প্যারাটিচারদেরও শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তা হলে তাঁদেরও একই ভাবে নিয়োগ করা হবে?
কী বললেন মুখ্যমন্ত্রী?
সম্প্রতি সুপ্রিম রায়ের পর মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, “সরকার চালাতে গেলে সবাইকেই আইন মেনে চলতে হয়। আইনের বাইরে গিয়ে নিজেদের মতো কিছু করলে কোর্ট অন্যভাবে নিতে পারে। আমরা রিভিউ পিটিশন করেছি। সুপ্রিম কোর্টে এখন গরমের ছুটি চলছে। সঠিক সময়েই রিভিউ পিটিশন করেছে রাজ্য। সেই আবেদনে কারও চাকরি যাওয়ার কথা বলা হয়নি। আমাদের একটা সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ৩১ মে পর্যন্ত আমাদের সময় বেঁধে দিয়েছে। যারা চাকরি করছেন তাদের চাকরি থাকার কথা বলা হয়েছে। আমরা চাই প্রত্যেকে চাকরি ফিরে পাক। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী সবটাই রেডি রাখব। কোর্ট বললে আপনাদের পরীক্ষা দিতে হবে না। সুপ্রিম কোর্টের যেহেতু অর্ডার আছে যে ৩১ মে-র মধ্যে করতে হবে, আমরা এতদিন অপেক্ষা করছিলাম, কোনও পদক্ষেপ করিনি। ভেবেছিলাম রাজ্যের রিভিউ পিটিশন নিয়ে আলোচনা হবে। যেহেতু এখনও রিভিউ হয়নি। ওটা পেন্ডিং আছে। কোর্টে গরমের ছুটি আছে। আমাদের হাত বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বাধ্য হয়ে জানাচ্ছি, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ৩১ মের মধ্যে নোটিফিকেশন করব। রিভিউতে ভালো রেজাল্ট হলে সেটাকেই গ্রহণ করব। পরে যাতে সুপ্রিম কোর্ট বলতে না পারে যে কেন নির্দেশ মানা হয়নি, আইন মেনেই কাজটা করতে হচ্ছে। রিভিউয়ের রাস্তা খোলা থাকছে। ৩০ মে এটা আমাদের করতে হবে। আমরা বিজ্ঞাপন দেব। এখনই বলা উচিত নয়, যে আমরা পরীক্ষা দেব না। তাহলে তো চাকরিটাই থাকবে না। ৩০ মে নোটিফিকেশন। পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি দেবে সরকার। ১৬ জুন-১৪ জুলাই অনলাইনে আবেদন। ১৫ নভেম্বর মেধাতালিকা প্রকাশ। ২০ নভেম্বর থেকে কাউন্সিলিং। নবম দশমে ১১,৫১৭ শিক্ষকের শূন্যপদ আছে। একাদশ-দ্বাদশে ৬,৯১২ শূন্যপদ। বয়সের জন্য আটকাবে না। প্রত্যেকেই পরীক্ষায় বসতে পারবেন। আপাতত সবাইকেই পরীক্ষায় বসতে হবে।”
চাকরিহারা শিক্ষকদের নিয়ে কী বললেন মোদী?
রাজ্যের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বৃহস্পতিবার আলিপুরদুয়ারের জনসভা থেকে তিনি বলেন, ‘এই দুর্নীতির জেরে হাজার হাজার গরিব ঘরের শিক্ষিত তরুণ-তরুণী আজ কর্মহীন। তাঁদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে তৃণমূল সরকার।’ মোদীর অভিযোগ, ‘গোটা রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে ছেলেখেলা করেছে তৃণমূল নেতারা। এত বড় পাপ করেও তারা নিজেদের দোষ মানছে না, বরং আদালতকে দোষারোপ করছে।’
মোদীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন চাকরিহারারা
প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যের পরে চাকরিহারা এক শিক্ষক সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের কথা বলেছেন। এতে কিছুটা হলেও আমরা বুঝতে পারছি যে তিনি আমাদের কথা জানেন। কিন্তু আমরা তো দেখা করতে চেয়েছিলাম, আমাদের যে প্রতিনিধিরা আলিপুরদুয়ারে রয়েছেন তাঁরা দেখা করতে চেয়েছিলেন, গত কয়েকদিন ধরে দেখা করতে চেয়েছিলেন, আমরা হতাশ যে তিনি দেখা করলেন না। আমরা চাইব প্রধানমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে দেখা করুন। সেই সঙ্গেই তিনি জানিয়েছেন, আইনের লড়াই তো চলবেই। কিন্তু আমাদের কথা যদি আমরা সরাসরি পৌঁছে দিতে পারতাম তাহলে অবশ্যই ভালো লাগত।
তবে অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর এই সমালোচনার পাল্টা নিশানা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। নবান্নে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সবথেকে বড় ভ্রষ্টাচারী তো আপনার সরকার। আপনি SSC নিয়ে কথা বলছেন? এটা কে করেছে? কোর্টে কেস সিপিএম এবং বিজেপি করেছে। ব্যাপম কেলেঙ্কারিতে কী হয়েছিল? বিজেপির সরকার ছিল। ফল কী হয়েছিল? ত্রিপুরায় ১০ হাজার শিক্ষককে সরিয়ে দিলেন। উত্তর প্রদেশে ৬৯ হাজার শিক্ষকের চাকরি গিয়েছে। আমরা মানবিক। কোনও না কোনও রাস্তা ঠিক বের করব। আবার কোর্টের নির্দেশও মানব। পর্দার পিছনে কে আছে, এর রিপ্লাই কে দেবে? কোর্টকে নিরপেক্ষভাবে চলতে দিন। আপনি তো কোর্টকে নির্দেশ দেন। সেটা আপনার কথাতেই প্রমাণ হয়ে যায়।”
এক নজরে এসএসসি দুর্নীতি মামলা
সম্প্রতি ২০১৬ সালের এসএসসিতে নিয়োগের পুরো প্যানেল বাতিল করেছে সুপ্রিম কোর্ট। যার ফলে প্রায় ২৬ হাজার জনের চাকরি (আদতে ২৫,৭৩৫) চাকরি বাতিল হয়েছে। তবে এই দুর্নীতির শুরু ২০১৬ সালে।
২০১৬তে এসএসসি-তে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এসএসসি-তে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। ওই বছরই ২৭ নভেম্বর ওএমআর শিটে পরীক্ষা নেওয়া হয়। এর দু’বছর পর ২০১৮ সালের ১২ মার্চ প্রকাশ করা হয় চূড়ান্ত প্যানেল। ২৮ অগস্ট প্রকাশিত হয় প্যানেলভুক্ত প্রার্থীদের মেধাতালিকা।
২০১৯ সালে নিয়োগ
এরপর ২০১৯ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে শিক্ষক হিসাবে চাকরি পান নির্বাচিতেরা। নতুন চাকরি। স্কুলে যাচ্ছিলেন শিক্ষকরা। তবে বিপদ আসে ২০২১ সালে।
২০২১-এ দুর্নীতির অভিযোগ
২০১৬ সালের সেই নিয়োগপ্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০২১ সালে। কলকাতা হাই কোর্টে দায়ের হয় একগুচ্ছ মামলা। অভিযোগ ওঠে, গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি কর্মী, নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগে যথেচ্ছ দুর্নীতি হয়েছে। ২০২১ সালে ওই সংক্রান্ত একটি মামলায় প্রথম সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন হাই কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তার পরের দু’বছরে নিয়োগ দুর্নীতির প্রায় ১০টি মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। সিবিআইয়ের তদন্তের পাশাপাশি ‘বেআইনি নিয়োগ’ বাতিল করারও নির্দেশ দেন প্রাক্তন বিচারপতি।
ওই প্রতিবেদন অনুসারে জানা গিয়েছে, তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্য়ায়ের কিছু রায় স্থগিত করে দিয়েছিল হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডনের ডিভিশন বেঞ্চ। পরে আবার সিঙ্গল বেঞ্চের কিছু রায় বহাল রাখে হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি সুব্রত তালুকদারের ডিভিশন বেঞ্চ। এরপর এই সমস্ত নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে ফের শুরু হল মামলা। সুপ্রিম কোর্টে বিক্ষিপ্তভাবে একের পর এক মামলা হতে থাকে। এরপর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসু ও বিচারপতি বেলা এম ত্রিবেদীর বেঞ্চ জানিয়ে দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি একটা বিশেষ বেঞ্চ গঠন করবেন। সেখানেই এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলার যাবতীয় শুনানি হবে। সেটা ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ। সেই অনুসারে ২০২৪ সালের ১৫ জানুয়ারি বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও বিচারপতি মহম্মদ শব্বদ রশিদির বিশেষ বেঞ্চে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ১৭টি শুনানি হয়েছিল। এরপর ২০২৪ সালের ২২ এপ্রিল ২৮২ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণা করল হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ।
হাইকোর্টের রায়
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল ২০১৬ সালের এই নিয়োগ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪ ও ১৬ ধারা লঙ্ঘনকারী। পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। রায়ে বলা হয়েছিল চাকরি যাবে ২৫, ৭৫৩জনের। ওই মামলায় সিবিআইকে তদন্ত করে তিন মাসের মধ্য়ে নিম্ন আদালতে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট।
সুপ্রিম কোর্টের রায়
হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চের রায় ঘোষণার ৪৮ ঘণ্টা মধ্যে সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল রাজ্য। ২৯শে এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্রের বেঞ্চে মামলাটি শুনানির জন্য ওঠে। পৃথক ভাবে শীর্ষ আদালতে মামলা করে রাজ্যের শিক্ষা দফতর, এসএসসি এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। দফায় দফায় মামলা করেন চাকরিহারারাও।
২০২৪ সালের ৭ মে হাই কোর্টের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট জানায়, এই মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পর বেআইনি ভাবে নিযুক্ত ব্যক্তিদের পুরো বেতন ফেরত দিতে হবে। পাশপাশি, সিবিআই-কে হাই কোর্টের নির্দেশ মেনে বেআইনি ভাবে যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করার ছাড়পত্র দেয় সু্প্রিম কোর্ট। এর পর ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট জানায়, ওই মামলায় প্রধান পাঁচটি পক্ষ— পশ্চিমবঙ্গ সরকার, এসএসসি এবং মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, হাই কোর্টের মূল মামলাকারীরা, হাই কোর্টের নির্দেশে যাঁদের চাকরি বাতিল হয়েছে এবং সিবিআই-এর বক্তব্য শুনবে আদালত।
২০২৫-এ চাকরি বাতিল
সুপ্রিম কোর্টে এই মামলাটি মোট ২০ বার শুনানির জন্য ওঠে। বিভিন্ন পক্ষের প্রায় ৪০০ আইনজীবী মামলায় যোগ দেন। শেষমেশ ২০২৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মামলার শুনানি শেষ হয় প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চে। রায় ঘোষণা স্থগিত রাখে আদালত। সম্প্রতি ওই মামলাতেই রায় ঘোষণা হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার জনের নিয়োগ।
এতকিছুর পর আজ, ৩০ মে প্রায় দশ বছর পর সুপ্রিম নির্দেশে নতুন পরীক্ষা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করল এসএসসি। এবারের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা হবে আরও বহু গুণ বেশি। ফলে এই লড়াই অনেকটাই কঠিন।