নিউজ ডেস্ক: প্রতিবার বর্ষা এলেই এক অভিন্ন দৃশ্য- শহরের রাস্তাঘাট জলে ডুবে যাচ্ছে, যানজট, ঘরবন্দি মানুষ, বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন অঞ্চল, আর প্রশাসনের ব্যর্থতার অভিযোগে মুখর জনমত। এই চিত্রটা নতুন কিছু নয়, অন্তত গত এক দশকে নয়। কলকাতা হোক বা হাওড়া, নিউ টাউন হোক বা বারাসত—একটি ভারী বৃষ্টিতেই যেন গোটা শহর ভেসে যায়। কেন?
বর্ষার দাপট কি এতটাই যে, তাকে আটকানো অসম্ভব? নাকি সমস্যার মূলে রয়েছে অপরিকল্পিত শহরায়ন, পুরনো পরিকাঠামো, দুর্বল প্রশাসনিক প্রস্তুতি, আর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব? আজ এই প্রশ্নটাই সবচেয়ে জরুরি।
বর্ষার জলাবদ্ধতা: প্রাকৃতিক দুর্যোগ না প্রশাসনিক ব্যর্থতা?
প্রতিবার বর্ষা এলেই এক অভিন্ন দৃশ্য: শহরের রাস্তাঘাট জলে ডুবে যাচ্ছে, যানজট, ঘরবন্দি মানুষ, বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন অঞ্চল, আর প্রশাসনের ব্যর্থতার অভিযোগে মুখর জনমত। এই চিত্রটা নতুন কিছু নয়, অন্তত গত এক দশকে নয়। কলকাতা হোক বা হাওড়া, নিউ টাউন হোক বা বারাসত—একটি ভারী বৃষ্টিতেই যেন গোটা শহর ভেসে যায়। কেন? বর্ষার দাপট কি এতটাই যে, তাকে আটকানো অসম্ভব? নাকি সমস্যার মূলে রয়েছে অপরিকল্পিত শহরায়ন, পুরনো পরিকাঠামো, দুর্বল প্রশাসনিক প্রস্তুতি, আর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব? আজ এই প্রশ্নটাই সবচেয়ে জরুরি।
বর্ষার পূর্বাভাস: সতর্কতা থাকলেও কার্যকর প্রস্তুতি নেই
প্রতিবার বর্ষাকালে আবহাওয়া দফতর ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেয়। ২০২৫ সালের মে মাসের শেষ সপ্তাহেও দক্ষিণবঙ্গে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নিয়ে আগেভাগে সতর্কতা জারি হয়। নবান্ন থেকে জেলা ও ব্লক পর্যায়ে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়, প্রশাসনিক স্তরে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে বর্ষার প্রথম বড় বৃষ্টিতেই দেখা যায় জলাবদ্ধতা, পাম্প চলতে না পারা, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, এবং কচুরিপানায় বন্ধ হয়ে যাওয়া নালা।
পরিস্থিতি বোঝায় যে সতর্কতার ঘোষণাই শুধু ‘কাগজে কলমে’ রয়ে গেছে, বাস্তবায়নে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। প্রশাসনিক প্রস্তুতি কেবলই সত্ত্বেও লোকজন প্রতিবারই বর্ষার শুরুতেই অভিজ্ঞ হয় একই দুর্ভোগে। তথ্য প্রাপ্তি ও স্থানীয় পর্যায়ে তৎপরতা নেই যথেষ্ট মাত্রায়, যা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে দুর্বল করে তোলে।
পুরনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও অপরিকল্পিত নগরায়ন: জলাবদ্ধতার মূল শত্রু
কলকাতা ও তার আশেপাশের শহরগুলোর জলনিষ্কাশন ব্যবস্থা এখনও ১৯৫০-৬০ দশকের পরিকল্পনার ওপর নির্ভরশীল। সেই সময়ের প্রযুক্তি ও জনসংখ্যার মাত্রার ভিত্তিতে তৈরি এই অবকাঠামো আজকের বিশাল জনসংখ্যা ও নগরায়নের চাহিদা মেটাতে অক্ষম।
শহরে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য নতুন বিল্ডিং, রাস্তা, বাণিজ্যিক এলাকা, কিন্তু খাল, জলাশয় ও প্রাকৃতিক জলপথগুলো দখল হওয়ায় ড্রেনেজ ব্যবস্থার গতিপথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে বর্ষার প্রথম বড় বৃষ্টিতেই জল আটকে যায়। নিউ টাউন, রাজারহাট, বরাহনগর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলাসহ নতুন গড়ে ওঠা এলাকাগুলিতেও একই সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। সেখানে পরিবেশগত প্রভাবের যথাযথ মূল্যায়ন না করে নির্মাণকাজ চলছে। খাল ভরাট, অবরুদ্ধ লকগেট, ভাঙা ও অপচয় পাম্প স্টেশনগুলোর কারণে জল বেরিয়ে যেতে বিলম্ব হয়।
এই অবস্থা প্রতিবারই পুনরাবৃত্তি হওয়ায় জনগণের দুর্ভোগ বেড়েই চলছে।
দুর্বল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও তথ্যের অভাব
জেলার প্রতিটি ব্লকেই কন্ট্রোল রুম থাকলেও সেগুলোর কার্যকরীতা অনেক প্রশ্নবিদ্ধ। সচেতনতার অভাব, স্থানীয় পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দুর্বল সমন্বয়, এবং জরুরি তথ্য সঠিক সময়ে পৌঁছানোর অভাব গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠীকে আগাম সতর্ক করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে ঝড়-বৃষ্টির সময় তারা সঠিক সুরক্ষা ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দিকেও নজর দেওয়া হয়নি যথেষ্ট মাত্রায়। প্লাস্টিক ও আবর্জনা নালা ও খালে জমে জল প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগের অভাব ও কর্পোরেট দায়বদ্ধতার স্বল্পতা সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে।
জলবায়ু পরিবর্তন: প্রকৃতির রোষ ও মানুষের অপ্রস্তুতি
বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক জলবায়ু সংস্থাগুলোর রিপোর্ট স্পষ্ট করেছে, পূর্ব ভারতের উপকূলবর্তী রাজ্যগুলোতে আগামী দশকে বৃষ্টিপাতের মাত্রা এবং ঝড়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। তবে বর্তমান অবকাঠামো ও প্রশাসনিক প্রস্তুতি সেই বাড়তি চাপ সামলাতে যথেষ্ট নয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি এবং কার্যকর পরিকল্পনার অভাবই জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ।
রাজনৈতিক ছলচাতুরি ও দায়দায়িত্ব এড়ানো
রাজনৈতিক পর্যায়ে বর্ষার জলাবদ্ধতার সমস্যাকে প্রায়ই গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বর্ষাকালে জলমগ্নতার ঘটনাগুলো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা অন্য দলের বিরুদ্ধে অভিযোগের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অভাব, প্রশাসনিক ত্রুটি এবং রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির স্বল্পতা এ সমস্যাকে গভীরতর করে তোলে।
রাজনৈতিক দলের অগ্রাধিকার তালিকায় বর্ষার জলাবদ্ধতা সাধারণত শীর্ষ স্থান পায় না। বরং নির্বাচনী সময়ে এই সমস্যাকে সাময়িক রাজনৈতিক লাভের জন্য ব্যবহারের প্রক্রিয়াই চলছে। ফলে বাস্তব সমাধান পিছিয়ে পড়ছে।
নাগরিক জীবনে জলাবদ্ধতার প্রভাব
জলাবদ্ধতা শুধু যানজট বা জল জমার সমস্যাই নয়, এটি নাগরিক জীবনের প্রতি গভীর প্রভাব ফেলে। স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যায়, অফিস ও জরুরি পরিষেবায় বিলম্ব ঘটে। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এই দুর্ভোগ মারাত্মক, কারণ তারা অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে পারে না। বস্তিতে বসবাসকারী মানুষ এই সময় দুর্ভোগের শীর্ষে থাকে।
ব্যবসা-বাণিজ্য ও পরিবহন ব্যবস্থাও বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে। এর ফলে রাজ্যের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়ে যা পরোক্ষভাবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় সংকট সৃষ্টি করে।
আধুনিক প্রযুক্তি ও টেকসই পরিকল্পনার অভাব
অন্যান্য বড় শহর যেমন মুম্বাই, চেন্নাই শহরগুলোতে আধুনিক জলনিষ্কাশন, স্টর্ম ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট এবং রেন ওয়াটার হারভেস্টিং প্রযুক্তি চালু রয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের শহরগুলোতে এই দিকগুলোর প্রতি নজর দেওয়া হয়নি যথেষ্ট মাত্রায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এমন প্রযুক্তির ভিত্তিতে পরিকল্পনা তৈরি এবং বাস্তবায়ন এখন সময়ের সর্বোচ্চ দাবি।
করণীয়: দীর্ঘমেয়াদী ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ
পশ্চিমবঙ্গের জলাবদ্ধতা দূরীকরণে এখনই একটি সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। আধুনিক জলনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার, বিশেষ করে স্টর্ম ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট এবং রেন ওয়াটার হারভেস্টিং-এর ওপর জোর দিতে হবে। খাল, নালা ও জলাশয়ের সংস্কারে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত এবং বর্ষার আগে এগুলো পরিষ্কার রাখা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
অবৈধভাবে জলাশয় ভরাট বন্ধ করতে হবে এবং পরিবেশগত মূল্যায়ন জোরদার করে কনস্ট্রাকশন লাইসেন্স দেওয়া উচিত। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় আরও সক্রিয় করা এবং স্থানীয় স্তরে কার্যকরী করতে হবে। শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করে প্লাস্টিক ও আবর্জনা থেকে নালাগুলো মুক্ত রাখতে হবে। নগর পরিকল্পনা ও নির্মাণে পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব বিবেচনায় টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
প্রকৃতি নয়, মানুষের তৈরি দুর্যোগ
বাংলায় বর্ষা আসা একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, কিন্তু জলমগ্নতা এবং নাগরিক দুর্ভোগ সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট। দীর্ঘ দশকের একঘেয়ে জলাবদ্ধতার মধ্যেও যদি প্রশাসনিক ইচ্ছাশক্তি ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার অভাব থাকে, তবে এটি শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত বা অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, বরং সামাজিক ও নৈতিক ব্যর্থতাও।
নাগরিক হিসেবে আমাদের দাবি হওয়া উচিত শুধু দৈনন্দিন ভোগান্তির অবসান নয়, বরং একটি স্বচ্ছ, সুশৃঙ্খল ও কার্যকরী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বর্ষার জলাবদ্ধতার সমস্যা চিরতরে মুছে ফেলা। প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সাধারণ মানুষকে মিলেমিশে এই সংগ্রামে এগিয়ে আসতে হবে। এটাই বাংলার জন্য একটি নিরাপদ, উন্নত ও আধুনিক শহর গড়ার একমাত্র পথ।