নিউজ ডেস্ক: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঁদুর নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, “অপারেশন সিঁদুর নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। প্রত্যেক মহিলার সিঁদুরের প্রতি সম্মান রয়েছে। তাঁরা স্বামীদের থেকে সিঁদুর নেন। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, কিন্তু আপনি তো সবার স্বামী নন। আপনি কেন আগে আপনার স্ত্রীকে সিঁদুর দেন না?” মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সিঁদুর’ মন্তব্যের প্রতিবাদে বিজেপির বিক্ষোভ ঘিরে উত্তেজনা হুগলির চুঁচুড়ায়। মহিলা পুলিশকর্মীদেরই সিঁদুর পরিয়ে দিলেন বিজেপি কর্মীরা! যার জেরে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হল।
অপারেশন সিঁদুরকে রাজনীতিকরণের চেষ্টা বিজেপির
কংগ্রেসের সিনিয়র নেতা ও সাংসদ জয়রাম রমেশ বিজেপির বিরুদ্ধে ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর রাজনীতিকরণের অভিযোগ এনেছেন এবং বলেছেন যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এনডিএ শাসিত রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের সাথে অপারেশন সিন্দুর এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানের আগ্রাসনের প্রতি ভারতের কার্যকর প্রতিক্রিয়া নিয়ে দেখা করবেন বলে খবর পাওয়া গেছে। রাজনৈতিক সমাবেশের মাধ্যমে অপারেশন সিঁদুরকে রাজনীতিকরণের চেষ্টা বিজেপির, যা কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ মন্তব্য তৃণমূল রাজ্যসভা সাংসদ সাগরিকা ঘোষের।
অনুব্রত মণ্ডল এরপরই এক পুলিশকর্মীর মা ও বোনকে নিয়ে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার
সোশ্যাল মাধ্যমে একটি অডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়। তাতে শোনা যায় বোলপুর থানার আইসি লিটন হালদারকে অশ্রাব্য ভাষায় গালমন্দ করছেন বীরভূম জেলার প্রাক্তন জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। সেই গালমন্দের বহর এমনই যে কান পাতা দায়। শুধু সেই পুলিশ অফিসার নয়, ফোনে গালমন্দ করার সময়ে তাঁর স্ত্রী ও মা সম্পর্কে নোংরা কথা বলেন অনুব্রত মণ্ডল। সূত্রের খবর, যা শুনে পুলিশ ও প্রশাসনের অন্দর আন্দোলিত হয়ে যায়।
তৃণমূল নেতাদের মহিলাদের নিয়ে অপমানজনক ও অসম্মানজনক মন্তব্য
তৃণমূল কংগ্রেসের (TMC) একাধিক নেতার বিরুদ্ধে মহিলাদের প্রতি অপমানজনক ও অসম্মানজনক মন্তব্য করার অভিযোগ উঠেছে, যা বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এই ধরনের মন্তব্যের ফলে দলীয় শৃঙ্খলা ও জনমতের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
১. অনুব্রত মণ্ডল
২০২৫ সালের মে মাসে, তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের একটি অডিও ক্লিপ প্রকাশ্যে আসে, যেখানে তিনি বোলপুর থানার ইনচার্জ লিটন হালদার ও তাঁর পরিবারকে উদ্দেশ্য করে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ ও হুমকি দেন। এই ঘটনার পর, দলের চাপের মুখে তিনি ৪০ মিনিটের মধ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চান।
২. অতীশ সরকার
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে, আরজি কর হাসপাতালের একটি ঘটনার প্রতিবাদে এক সভায় অতীশ সরকার প্রতিবাদী মহিলাদের ছবি বিকৃত করে দেওয়ালে টাঙিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। এই মন্তব্যের জন্য তাঁকে এক বছরের জন্য দল থেকে সাসপেন্ড করা হয়।
৩. ফিরহাদ হাকিম
২০২৫ সালে, ফিরহাদ হাকিম বিজেপি নেত্রী রেখা পাত্রাকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন, যা মহিলাদের প্রতি অসম্মানজনক বলে সমালোচিত হয়। এই মন্তব্যের জন্য বিজেপি নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করে।
৪. মহুয়া মৈত্র
২০২৪ সালের জুলাইয়ে, তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন রেখা শর্মাকে নিয়ে ‘পাজামা’ মন্তব্য করেন, যা সামাজিক মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি করে। এই মন্তব্যের জন্য দিল্লি পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
এই ঘটনাগুলি তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের দ্বারা মহিলাদের প্রতি অপমানজনক মন্তব্যের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য। এই ধরনের মন্তব্যের ফলে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে এবং জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও একাধিকবার মহিলাদের প্রতি অসম্মানজনক মন্তব্য
পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডে ঘটনাটিকে “ঘটনাটাই সাজানো” বলে উড়িয়ে দেন
২০১২ সালে কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে সংঘটিত ধর্ষণ মামলাটি নিয়ে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। তিনি এই ঘটনাটিকে “সাজানো ঘটনা” বলে অভিহিত করেন এবং অভিযোগ করেন যে এটি তাঁর সরকারকে কলঙ্কিত করার জন্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত। এই মন্তব্যের ফলে ব্যাপক সমালোচনা হয় এবং পরে তিনি তাঁর বক্তব্য থেকে সরে আসেন। এই মামলার তদন্তে নেতৃত্ব দেন কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) দময়ন্তী সেন। তিনি অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করে প্রমাণ করেন যে ঘটনাটি সত্যিই সংঘটিত হয়েছে। তবে এই তদন্তের পরপরই তাঁকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, যা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ইঙ্গিত দেয়। এই ঘটনাটি পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিবেশে নারীদের প্রতি সংবেদনশীলতা এবং ধর্ষণ মামলার প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
২০১৩ সালের কামদুনি গণধর্ষণের প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারী স্থানীয় মহিলাদের “বাইরের লোক” বলে অভিহিত করেন মমতা
২০১৩ সালের কামদুনি গণধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের পর, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। তিনি স্থানীয় প্রতিবাদকারী মহিলাদের “সিপিএম সমর্থক” বলে অভিহিত করেন এবং অভিযোগ করেন যে এই প্রতিবাদ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই মন্তব্যের ফলে স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষুব্ধ হন এবং মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।
তৃণমূল বিধায়ক মদন মিত্র সাংবাদিক বৈঠকে এক মহিলা সাংবাদিককে উদ্দেশ্য করে প্রেমঘন মন্তব্য
তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক মদন মিত্র ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি সংবাদ সম্মেলনে মহিলাদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “ভারতীয় সংস্কৃতিতে এমনও দেখা যায় যেখানে পাঁচজন পুরুষ একজন স্ত্রীকে ভাগ করে নেন,” যা মহাভারতের দ্রৌপদী ও পাণ্ডবদের প্রসঙ্গে ইঙ্গিত করে। এই মন্তব্যের ফলে সামাজিক মাধ্যমে এবং রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনা হয়।
২০১২ সালে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ মামলার ভুক্তভোগী সুজেট জর্ডানের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে মদন মিত্র সমালোচিত হন। তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে, “রাত ২টায় অচেনা পুরুষদের সঙ্গে বেরোনো মহিলার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়।” এই মন্তব্যের জন্য তিনি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন।
এছাড়াও, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে, আরজি কর মেডিকেল কলেজের এক ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর, ভুক্তভোগীর পরিবারকে উদ্দেশ্য করে মদন মিত্র বলেন, “আপনারা যদি টাকা চান, তাহলে নিয়ে নিন এবং চুপ থাকুন।” এই মন্তব্যের ফলে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
২০২২ সালের নভেম্বর মাসে পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া সংলগ্ন দিনহাট পৌরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান শিশির মণ্ডলের একটি অডিও ফাঁস হয়। সেখানে শোনা যায়, এক ২৩ বছর বয়সি তরুণীর কাছ থেকে চাকরির বিনিময়ে তিনি ‘যৌন সুবিধা’ চাচ্ছেন। এই কু-প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ হয়, তবে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব এই বিষয়ে নীরব থাকে।
প্রকাশ্য সভামঞ্চে মহিলাকে কটুক্তি করে সমালোচনার মুখে পড়েন শ্রীরামপুরের তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
রাজ্যে মহিলাদের উপর হওয়া অপরাধের পরিসংখ্যান
২০১২ সালে, জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর (NCRB) প্রতিবেদনে পশ্চিমবঙ্গ মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের ক্ষেত্রে শীর্ষে ছিল, যেখানে ৩০,৯৪২টি ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছিল, যা দেশের মোট অপরাধের ১২.৬৭%। কলকাতা ছিল মহিলাদের জন্য তৃতীয় সর্বাধিক অরক্ষিত শহর, দিল্লি ও ব্যাঙ্গালোরের পর।
২০২৪ সালে, কলকাতার RG Kar মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে এক ৩১ বছর বয়সী মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ব্যাপক প্রতিবাদ ও আন্দোলন শুরু হয়। এই ঘটনায় হাসপাতালের প্রশাসনিক গাফিলতি ও প্রাথমিক তদন্তের অবহেলা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে ।
১. আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড (২০২৪)
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে, কলকাতার আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে এক ৩১ বছর বয়সী মহিলা চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় হাসপাতালের প্রশাসনিক গাফিলতি ও প্রাথমিক তদন্তের অবহেলা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এই ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলন ও বিক্ষোভের খবর প্রকাশিত হয়।
২. সন্দেশখালি নারী নির্যাতন ও সহিংসতা (২০২৪)
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে, উত্তর ২৪ পরগণার সন্দেশখালি এলাকায় তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা শেখ শাহজাহান ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে একাধিক মহিলাকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দারা বিক্ষোভ ও প্রতিবাদে অংশ নেন। সংবাদমাধ্যমে এই ঘটনার বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
৩. কামদুনি গণধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড (২০১৩)
২০১৩ সালে, উত্তর ২৪ পরগণার কামদুনি এলাকায় এক ১৬ বছর বয়সী স্কুলছাত্রী গণধর্ষণ ও হত্যার শিকার হন। এই ঘটনায় রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ ও আন্দোলন শুরু হয়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনার পর স্থানীয় মহিলাদের প্রতিবাদকে “বাইরের লোক” বলে অভিহিত করেন, যা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
তৃণমূল সরকারের শাসনামলে মহিলাদের নিরাপত্তার প্রশ্ন
পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার মহিলাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবী। তিনি জানান, রাজ্যে ধর্ষণ ও পকসো (POCSO) মামলার সংখ্যা বিপুল পরিমাণে বেড়েছে, কিন্তু সেগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর (NCRB) ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার মাত্র ৮.৯ শতাংশ, যা উদ্বেগজনকভাবে কম। এছাড়া, রাজ্যে মহিলাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের ৩,৫৬,৩৩০টি মামলা এখনও নিষ্পত্তি হয়নি, যা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবী আরও জানান, পশ্চিমবঙ্গের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ১২৩টি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট বরাদ্দ করেছে, যার মধ্যে ২০টি বিশেষ পকসো কোর্ট এবং ১০৩টি ধর্ষণ ও পকসো মামলার জন্য কোর্ট রয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকার ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত কোনো কোর্টই চালু করেনি।
এছাড়া, মহিলা হেল্পলাইন (১৮১ নম্বর) চালু করার বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও রাজ্য সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।