নিউজ ডেস্ক: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি বিশ্বকবি হিসেবে পরিচিত, তিনি কেবল একজন সাহিত্যিক নন—তিনি ছিলেন এক আধ্যাত্মিক চিন্তানায়ক, যিনি ঔপনিবেশিক ভারতের সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে এক নতুন জাতীয়তার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তিনি এমন এক ভারতের কল্পনা করেন, যা কেবলমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতা দিয়ে গঠিত নয়, বরং আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক পরিপূর্ণতায় পূর্ণ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ভারত যখন পশ্চিমা আধুনিকতা ও প্রাচ্য ঐতিহ্যের দ্বন্দ্বে ক্লান্ত, তখন রবীন্দ্রনাথ সেই দ্বৈততাকে অতিক্রম করে একটি সামগ্রিক ভাবনার সূচনা করেন। তাঁর কাছে ভারত ছিল আত্মার বাসস্থান—যেখানে আধ্যাত্মিকতা, মানবিকতা ও সংস্কৃতি ছিল জাতীয় সত্তার মূল ভিত্তি।
রবীন্দ্রনাথ রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেছেন তার বিভিন্ন রচনায়। তিনি জাতীয়তাবাদকে এক যান্ত্রিক ও বিভেদমূলক শক্তি হিসেবে দেখেছেন যা মানুষের আত্মাকে সংকীর্ণ করে। তাঁর ১৯১৭ সালে লেখা “Nationalism” বইটিতে তিনি ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের প্রভাব ও তার ফলাফলের তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁর মতে, একটি জাতির প্রকৃত গঠন সম্ভব মানবিক চেতনা, সহানুভূতি এবং নৈতিক বন্ধনের মাধ্যমে। তিনি মনে করতেন, জাতীয়তাবাদ যদি কেবল ভৌগোলিক সীমা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, তবে তা মানুষের মৌলিক আত্মবোধকে দমন করে।
এই ভাবনার বাস্তব প্রতিফলন ছিল শান্তিনিকেতন। ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি বিকল্প ভারতীয় সমাজচিন্তার কেন্দ্র। এখানে রবীন্দ্রনাথ এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেন, যেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশে, স্বাধীন চিন্তার মাধ্যমে, ছাত্রদের মনে জাগ্রত হবে মানবিক ও আধ্যাত্মিক চেতনা।
রবীন্দ্রনাথের এই আধ্যাত্মিক জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ঘটে তার সাহিত্য, সংগীত ও দার্শনিক রচনায়। তাঁর নোবেলজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘গীতাঞ্জলি’তে ঈশ্বর ও মানুষের সংলাপ, প্রকৃতি ও আত্মার মিলন, এবং চরম মানবতাবাদ প্রতিফলিত হয়েছে। এ কাব্যগ্রন্থ ভারতের আত্মিক ঐতিহ্যের এক আন্তর্জাতিক ব্যাখ্যা—যা পশ্চিমা জগতে ভারতের এক বিকল্প পরিচয় তুলে ধরে। তাঁর গান, বিশেষ করে “জনগণমন” ও “আমার সোনার বাংলা”, ভারতের জাতীয় চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠে। এই গানগুলো শুধু সংগীত নয়, বরং জাতির আত্মার উচ্চারণ, যা বিভাজনের সময়ে ঐক্যের আহ্বান জানায়।
বঙ্গভঙ্গের সময় রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। যেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্ব আন্দোলনকে সংঘর্ষমুখী করে তুলেছিল, সেখানে তিনি গান, উৎসব, রাখিবন্ধন ও সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানান। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাজনৈতিক বৈরিতা নয়, হৃদয় দিয়ে জাতীয় ঐক্য তৈরি সম্ভব। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই জন্ম নেয় রাখীবন্ধনের ঐতিহাসিক উৎসব, যা বিভাজনের বিরুদ্ধে ভালোবাসার এক আধ্যাত্মিক প্রতিরোধ হয়ে ওঠে।
ইউরোপে সফরকালে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমা জাতীয়তাবাদের আগ্রাসী রূপ প্রত্যক্ষ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি জাতিসংঘের মতো সংস্থাগুলির কার্যকারিতায় প্রশ্ন তোলেন এবং মানবিক চেতনার উপর ভিত্তি করে এক বিশ্বমানবতাবাদী সমাজের স্বপ্ন দেখেন। এখানেও তার আধ্যাত্মিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তি অটুট থাকে। তিনি মনে করেন, ভারত যদি প্রকৃতপক্ষে জেগে ওঠে তবে তাকে কেবল নিজের ঐতিহ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে না, বরং তাকে বিশ্বের সঙ্গে কথোপকথনে অংশ নিতে হবে একটি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক পরিসরে।
এই ভাবনারই সম্প্রসারণ ঘটে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠায়। এটি ছিল এমন এক প্রতিষ্ঠান যা পূর্ব ও পশ্চিমের সংলাপ, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। এখানে রবীন্দ্রনাথ এমন এক শিক্ষার কথা বলেন, যেখানে জাতীয়তার অর্থ কেবল দেশপ্রেম নয়, বরং মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতা। বিশ্বভারতী ভারতের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারের আধুনিক রূপ—যেখানে বৈশ্বিকতাও থাকে, কিন্তু নিজের শিকড় অক্ষুণ্ণ থাকে।
রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ধর্মীয় সহনশীলতাকেও যুক্ত করেন। তাঁর কাছে ধর্ম ছিল ব্যক্তির আধ্যাত্মিক উন্নয়নের পথ, যা কোনো একচেটিয়া সম্প্রদায়িক গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। তিনি মনে করতেন, ভারতবর্ষের বৈচিত্র্য—হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধদের সহাবস্থান—একটি আত্মিক সম্প্রীতির উদাহরণ, যা জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হতে পারে। এই কারণে তিনি ধর্মীয় কট্টরতা ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা করেন, এবং এক বহুস্বরিক ভারত গঠনের আহ্বান জানান।
রবীন্দ্রনাথ কেবল উচ্চশ্রেণির সাহিত্য বা শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। তাঁর শ্রীনিকেতন প্রকল্প ছিল গ্রামীণ উন্নয়নের এক পরীক্ষাগার—যেখানে কৃষি, স্বাস্থ্য, নারীশিক্ষা, স্বনির্ভরতা এবং লোকশিল্পকে কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি মনে করতেন, ভারতের আত্মা গ্রামে বাস করে, এবং যদি জাতীয়তাবাদ সত্যিই কার্যকর হয়, তবে তা গ্রামের মানুষের মধ্যেই শুরু হতে হবে। এখানে তিনি গান্ধীর সঙ্গে মিলিত হলেও, রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আরও নান্দনিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বিস্তৃত।
রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ তাই ছিল এক মানবিক চেতনার ভিত্তিতে নির্মিত, যেখানে ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা ও শ্রেণি-ভেদ নির্বিশেষে মানুষ মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত হয় আত্মিকভাবে। তাঁর চিন্তাধারা আজকের ভারতের জন্যও প্রাসঙ্গিক—যেখানে রাজনৈতিক মেরুকরণ, ধর্মীয় মেরুকরণ এবং সাংস্কৃতিক সংকীর্ণতা সমাজকে বিভক্ত করছে। রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছেন, ভারত যদি সত্যিকারের অর্থে জেগে ওঠে, তবে তাকে প্রথমে নিজের আত্মাকে চিনতে হবে।
এই কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন এক আধ্যাত্মিক জাতীয়তাবাদী—যিনি জাতীয়তাকে কেবল একটি ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেননি, বরং আত্মিক ও মানবিক ঐক্যের ভিত্তিতে এক বৃহত্তর ভারত নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর চিন্তা ও কাজের মধ্যে দিয়ে আজও আমরা অনুভব করি, কেমন করে একটি জাতি তার শিকড়ে ফিরে গিয়েও বিশ্বজনীন হয়ে উঠতে পারে।