নিউজ ডেস্ক: ১৯৮৪ সালে যখন রাকেশ শর্মা মহাকাশ থেকে বলেছিলেন, “সারে জাহাঁ সে আচ্ছা”, সেটি কেবল ভারতের রূপ-সৌন্দর্যের প্রশস্তিই ছিল না—তা ছিল এক নবজাগরণের ঘোষণা। তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল এক দেশের স্বপ্ন, যা আকাশ ছোঁয়ার সাহস দেখিয়েছিল। চার দশক পেরিয়ে, সেই স্বপ্নের উত্তরাধিকার এখন শুভ্রাংশু শুক্লার হাতে। গগনযান এবং অ্যাক্সিওম-৪ মিশনের মাধ্যমে তিনি শুধু মহাকাশে পা রাখছেন না, বরং ভারতের পতাকাকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের দেওয়ালে অক্ষয় করে তুলতে চলেছেন।
রাকেশ শর্মার পথপ্রদর্শন আর শুভ্রাংশু শুক্লার সাহসী অভিযাত্রার মাঝে রয়েছে ভারতের মহাকাশযাত্রার এক অবিস্মরণীয় পরিক্রমা—যেখানে উদ্ভাবন, অধ্যবসায় ও সাংস্কৃতিক গর্ব একসঙ্গে বোনা। এই যাত্রা প্রমাণ করে দিয়েছে—ভারতের কাছে আকাশ কোনো সীমা নয়, বরং নতুন সম্ভাবনার সূচনা।
রাকেশ থেকে শুভ্রাংশু: ভারতের মহাকাশ অভিযানের উত্তরাধিকার
ভারতের মহাকাশযাত্রা শুধুই প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কাহিনি নয়—এ এক স্বপ্ন দেখার সাহস, বৈজ্ঞানিক অধ্যবসায় এবং সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের গর্বের অনন্য নিদর্শন। ১৯৮৪ সালে রাকেশ শর্মার হাত ধরে শুরু হয়েছিল এই ইতিহাস; ২০২৫-এ সেই উত্তরাধিকার বহন করতে চলেছেন শুভ্রাংশু শুক্লা—যিনি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ভারতের পতাকা ও ভবিষ্যতের প্রত্যয় তুলে ধরতে প্রস্তুত। রাকেশ থেকে শুভ্রাংশুর এই দীর্ঘ পথচলা, একাধারে ইসরোর অগ্রগতির দলিল, তেমনই বৈশ্বিক মহাকাশ মানচিত্রে ভারতের দৃপ্ত পদচারণার প্রমাণ।
সূচনা লগ্ন: রাকেশ শর্মার ঐতিহাসিক উড্ডয়ন
১৯৮৪ সালের ৩ এপ্রিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সয়ুজ টি-১১ মহাকাশযানে পাড়ি জমিয়েছিলেন উইং কমান্ডার রাকেশ শর্মা, ইন্টারকসমস প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে। তিনিই প্রথম ভারতীয়, যিনি মহাকাশে গিয়েছিলেন। স্যালুট-৭ মহাকাশ স্টেশনে তাঁর ৮ দিনের সেই অভিযানে তিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালান—বিশেষ করে মাইক্রোগ্র্যাভিটিতে যোগাসনের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে কাজ করেন, তোলেন পৃথিবীর ছবি, যার মাধ্যমে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংকলিত হয়।
কিন্তু বিজ্ঞান ছাপিয়ে এই মিশন হয়ে ওঠে এক সাংস্কৃতিক স্মারক। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রশ্ন ছিল—“মহাকাশ থেকে ভারতকে কেমন দেখায়?” শর্মার উত্তর: “সারে জাহাঁ সে আচ্ছা।” এই একটি লাইনেই বন্দী হয়ে যায় ভারতীয় গর্ব, স্বপ্ন আর আত্মবিশ্বাস। বিশ্বমঞ্চে ভারত তখনও আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ে; শর্মার যাত্রা সেই সময় এক বিশাল মনোবল যোগায় জাতিকে। এই প্রথম বিশ্ব জানল—ভারতও তারাদের কাছে পৌঁছতে চায়, আর সে ইচ্ছার পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞান, সাহস এবং কৌশল।
ইসরোর অগ্রযাত্রা: স্বপ্নের ভিত্তি নির্মাণ
রাকেশ শর্মার যাত্রার সময়, ইসরো ছিল সদ্যোজাত এক সংস্থা, যার কাজ মূলত সাউন্ডিং রকেট ও উপগ্রহ উৎক্ষেপণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ইন্দো-সোভিয়েত অংশীদারিত্বে হলেও শর্মার এই অভিযানে ভবিষ্যতের স্বাধীন ভারতীয় মানব মহাকাশযাত্রার বীজ রোপিত হয়। এই স্বপ্ন তখন বাস্তব হতে বহু দূরে, কিন্তু সেই স্বপ্নের পেছনে দৌড় শুরু করে দিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা।
এরপরের কয়েক দশকে ইসরো এক নিরলস, নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াসের মাধ্যমে নিজেকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণায় এক উল্লেখযোগ্য শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭৫ সালে ভারতের প্রথম উপগ্রহ ‘আর্যভট্ট’-এর উৎক্ষেপণ হোক কিংবা ১৯৮০-র দশকে SLV-র উন্নয়ন, সবই ধাপে ধাপে তৈরি করে সেই ভিত্তি, যার উপর দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের চন্দ্রযান, মঙ্গলযান বা গগনযান গড়ে উঠেছে।
উড়ানের নবযুগ: উচ্চাকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন
২০০০-এর দশক থেকে ইসরো তার সেরা সময় পার করতে শুরু করে। পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল (PSLV) এবং জিওসিনক্রোনাস স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল (GSLV)-এর ধারাবাহিক সাফল্যে ভারতের উপগ্রহ উৎক্ষেপণ কর্মসূচি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে থাকে।
২০০৮-এ চন্দ্রযান-১ এবং ২০১৪-তে মঙ্গলযান—এই দুটি ঐতিহাসিক মিশনে ইসরো প্রমাণ করে দেয়, কম বাজেটেও অভূতপূর্ব সাফল্য সম্ভব। চাঁদে জলের অস্তিত্ব আবিষ্কার এবং প্রথম প্রচেষ্টাতেই মঙ্গলগ্রহে পৌঁছনো ভারতকে বৈশ্বিক মহাকাশ গবেষণার প্রথম সারিতে নিয়ে আসে। এই সাফল্য শুধু বিজ্ঞানীদের নয়, দেশের যুবসমাজ, ছাত্রছাত্রী, এমনকি নতুন প্রজন্মের মহাকাশচিন্তকদের মনেও আগুন ধরিয়ে দেয়। শুভ্রাংশু শুক্লা সেই আগুনেরই উত্তরসূরি।
উত্তরাধিকার ও ভবিষ্যৎ: শুভ্রাংশু শুক্লার অভিষেক
২০২৫ সালে গগনযান কর্মসূচির মাধ্যমে শুভ্রাংশু শুক্লা যখন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পা রাখবেন, তখন শুধু একজন ভারতীয় নয়, তিনিই হবেন সেই উত্তরাধিকারী—যাঁর শরীরের সঙ্গে বয়ে যাবে রাকেশ শর্মার রেখে যাওয়া গর্ব, ইসরোর পাঁচ দশকের অদম্য পরিশ্রম এবং ভারতের মহাকাশ স্বপ্নের পরিণতি। তাঁর মিশন কেবল প্রযুক্তিগত নয়, এটি একটি প্রজন্মের প্রতিশ্রুতি, যা বলে—আমরাও পারি, আরও উঁচুতে উড়তে, আমাদের নিজস্ব পাখায়।
শুভ্রাংশু শুক্লা: ভারতের মহাকাশ অভিযানে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা
২০২৫—ভারতের মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে আরেকটি স্মরণীয় বছর হতে চলেছে। কারণ, এই বছরই আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের (ISS) উদ্দেশে যাত্রা করতে চলেছেন ভারতীয় বায়ুসেনার গ্রুপ ক্যাপ্টেন শুভ্রাংশু শুক্লা। তিনি ইসরোর গগনযান প্রকল্পের অংশ এবং ভারতের সেই নবপ্রজন্মের মুখ, যাঁরা রাকেশ শর্মার রেখে যাওয়া উত্তরাধিকারের আলোকপথে হাঁটছেন, নতুন উচ্চতায় পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে।
কে এই শুভ্রাংশু শুক্লা?
১৯৮৫ সালের ১০ অক্টোবর, উত্তরপ্রদেশের লখনউতে জন্মগ্রহণ করেন শুভ্রাংশু শুক্লা। তিনি একাধারে একজন যুদ্ধবিমান চালক, টেস্ট পাইলট এবং মহাকাশচারী। তাঁর নাম বর্তমানে শুধু ভারতেই নয়, আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা মহলেও সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে।
২০০৬ সালে ভারতীয় বায়ুসেনায় অফিসার হিসেবে কমিশনপ্রাপ্ত শুক্লা এখনও পর্যন্ত সুখোই-৩০, মিগ-২১, মিগ-২৯, জাগুয়ার, হক ও ডর্নিয়ার-সহ বহু যুদ্ধবিমান ও প্রশিক্ষণ বিমানে ২০০০ ঘণ্টারও বেশি সময় উড্ডয়ন করেছেন। ২০২৪ সালে তাঁকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত করা হয়। তাঁর পেশাগত দক্ষতা, ধৈর্য, এবং প্রযুক্তিগত অন্তর্দৃষ্টি তাঁকে গগনযান মিশনের জন্য আদর্শ প্রার্থী করে তোলে।
প্রশিক্ষণ: মাটি থেকে মহাকাশের প্রস্তুতি
গগনযান অভিযানের অংশ হিসেবে শুভ্রাংশু শুক্লা প্রশান্ত বালাকৃষ্ণন নায়ার, অজিত কৃষ্ণন এবং অঙ্গদ প্রতাপের সঙ্গে ২০২০-২১ সালে রাশিয়ার ইউরি গ্যাগারিন কসমোনট ট্রেনিং সেন্টারে এক বছরেরও বেশি সময় কঠোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তাঁরা বেঙ্গালুরুর ইসরো মহাকাশচারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভারতীয় পরিকাঠামোয় নিজস্ব প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন।
এই প্রশিক্ষণের অন্তর্গত ছিল—
জিরো গ্র্যাভিটির বাস্তব অনুশীলন
মহাকাশযানে টিকে থাকার কৌশল
মহাকাশযান ও তার প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনা
এই প্রস্তুতি তাঁকে যে কোনও জরুরি পরিস্থিতি ও জটিল মহাকাশপরিবেশে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম করে তুলেছে।
গগনযান মিশন: ভারতের স্বাধীন মানব মহাকাশযানে লাফ
গগনযান মিশন ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ISRO-র জন্য এক ঐতিহাসিক মাইলফলক—যা কেবল স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ কিংবা গ্রহ অনুসন্ধানে সীমাবদ্ধ না থেকে এবার সরাসরি মানব মহাকাশ অভিযানের দিগন্তে পা রাখছে। ২০২৫–২০২৬ সালের মধ্যে তিনজন ভারতীয় মহাকাশচারীকে তিন দিনের জন্য নিম্ন পৃথিবী কক্ষপথে পাঠানোর লক্ষ্য নিয়ে গগনযান ভারতের জন্য হয়ে উঠেছে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এবং জাতীয় আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।
এই মিশনে মহাকাশচারী শুভ্রাংশু শুক্লার ভূমিকা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। মিশন বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর দায়িত্বের মধ্যে থাকতে পারে সিস্টেম মনিটরিং, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা পরিচালনা কিংবা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত সমন্বয়। এর মাধ্যমে প্রকাশ পাবে তাঁর বিশ্লেষণী দক্ষতা, প্রশিক্ষিত মানসিক দৃঢ়তা এবং দলগত কাজে পারদর্শিতা—যা এই জাতীয় উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তবে গগনযান শুধু একটি বৈজ্ঞানিক প্রকল্প নয়—এটি আত্মনির্ভর ভারতের স্বপ্নের একটি বাস্তব রূপ। কোভিড-১৯ মহামারী, প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ এবং একাধিক বার মিশনের সময়সীমা পিছিয়ে যাওয়ার মধ্যেও ISRO তার নিষ্ঠা ও উৎকর্ষতা বজায় রেখেছে। ২০২৪ সালে সফল সিমুলেটেড টেস্ট ফ্লাইট এই মিশনের প্রস্তুতির দৃঢ়তা এবং অগ্রগতিকে নিশ্চিত করেছে।
এই গগনযান অভিযানে যাত্রা করা শুক্লা ও তাঁর সহমহাকাশচারীরা হয়ে উঠেছেন এক নতুন ভারতের মুখ—যেখানে বিজ্ঞান, আত্মবিশ্বাস এবং স্বপ্ন একসঙ্গে পথ হাঁটে। তাঁরা কেবল মহাকাশে নয়, ভারতীয় তরুণ প্রজন্মের কল্পনাশক্তির মধ্যেও উড়ে বেড়াচ্ছেন। এই মিশন ভবিষ্যতের এক শক্তিশালী বার্তা: ভারত এখন শুধু পৃথিবী নয়, মহাকাশেও নিজের পতাকা উড়াতে প্রস্তুত।
আন্তর্জাতিক অভিযানে ভারতের প্রতিনিধি
শুধু গগনযান নয়, শুভ্রাংশু শুক্লা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযানের মুখ্য অংশ—অ্যাক্সিওম-৪ (Axiom-4) মিশন। এটি একটি বেসরকারি আন্তর্জাতিক মহাকাশ অভিযান, যেখানে শুক্লা নির্বাচিত হয়েছেন NASA এবং ISRO-র যৌথ উদ্যোগে।
এই মিশনের মাধ্যমে তিনি হবেন—
রাকেশ শর্মার ৪১ বছর পর দ্বিতীয় ভারতীয় মহাকাশচারী,
এবং
প্রথম ভারতীয়, যিনি একটি প্রাইভেট মিশনের মাধ্যমে ISS-এ পা রাখতে চলেছেন।
স্পেসএক্স-এর ড্রাগন ক্যাপসুলে করে এই চার সদস্যের দল পাড়ি দেবে মহাকাশে। মিশন লঞ্চ হবে নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টার (ফ্লোরিডা)থেকে।
কে কে থাকছেন শুক্লার সঙ্গী হিসেবে?
অ্যাক্সিওম-৪ মিশনে শুভ্রাংশু শুক্লার সঙ্গে থাকছেন—
ড. পেগি হুইটসন – প্রাক্তন NASA অ্যাস্ট্রোনট এবং এই মিশনের কমান্ডার
সাওজ উজনানস্কি-উইসনিয়েস্কি – ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ও পোল্যান্ডের প্রতিনিধি
টিবর কাপু – হাঙ্গেরির প্রতিনিধি ও স্পেস রিসার্চার
এই টিমের সঙ্গে শুক্লা ভারতের পতাকা বহন করবেন একটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে—যেখানে বিজ্ঞান, সহযোগিতা ও ভবিষ্যতের প্রযুক্তি এক সুতোয় বাঁধা।
মহাকাশে ভারতের নতুন অধ্যায়ের লেখক
শুভ্রাংশু শুক্লার এই অভিযানে অংশগ্রহণ শুধুমাত্র ব্যক্তিগত গর্বের বিষয় নয়, বরং এটি ভারতীয় মহাকাশযাত্রার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। গগনযান এবং অ্যাক্সিওম, উভয় অভিযানে তাঁর ভূমিকা ভারতের প্রযুক্তিগত ক্ষমতা, আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা এবং মহাকাশ অন্বেষণে নেতৃত্ব দেওয়ার আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠছে।
একুশ শতকের এই ‘মহাকাশ সেনানী’ আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছেন—রাকেশ শর্মার উত্তরাধিকার শুধু ইতিহাস নয়, তা এখন বাস্তব ভবিষ্যত।
ভারতীয় মহাকাশ অভিযানের উত্তরাধিকার: ধারাবাহিকতা ও বিবর্তনের কাহিনি
রাকেশ শর্মা থেকে শুভ্রাংশু শুক্লা—এই দুই নামের মধ্যে সময়ের ব্যবধান যেমন বিস্তৃত, তেমনি বিস্তৃত ভারতের মহাকাশ অভিযানের বিবর্তনও। ১৯৮৪ সালে রাকেশ শর্মার ঐতিহাসিক মহাকাশযাত্রা ছিল সোভিয়েত সহযোগিতার ফসল, যা সে সময় ভারতের সীমিত প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো এবং বিদেশি নির্ভরতার এক প্রতিচ্ছবি। আর আজ, শুভ্রাংশু শুক্লা যে গগনযান এবং অ্যাক্সিওম-৪-এর মতো মিশনে অংশ নিচ্ছেন, তা ভারতের একটি আত্মনির্ভর, পরিণত ও উচ্চ-প্রযুক্তির মহাকাশশক্তিতে পরিণত হওয়ার পরিচায়ক।
এই রূপান্তর কেবল একটি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়, বরং ভারতের বৈজ্ঞানিক ও কৌশলগত আত্মবিশ্বাসের এক অনন্য ঘোষণা। গগনযান মিশনের মাধ্যমে ভারত এখন নিজস্ব প্রযুক্তিতে মহাকাশে মানুষ পাঠাতে সক্ষম—এটি ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ মহাকাশ গবেষণার শিখর স্পর্শ করার পথে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
রাকেশ শর্মা ও শুভ্রাংশু শুক্লার মধ্যে কিছু মিলও লক্ষণীয়—দু’জনেই ভারতীয় বিমানবাহিনীর সদস্য, পেয়েছেন কঠোর প্রশিক্ষণ, আর দু’জনেই জাতীয় গর্ব ও দায়িত্ববোধে অনুপ্রাণিত। শর্মার “সারে জাঁহাসে আচ্ছা” উত্তর এক সময় গোটা দেশকে গর্বিত করেছিল, আর শুক্লা এখন সেই ঐতিহ্যের উত্তরসূরি হয়ে নতুন প্রজন্মকে মহাকাশ ও বিজ্ঞানমুখী ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে অনুপ্রাণিত করছেন।
এই দুই মহাকাশচারীর যাত্রা প্রমাণ করে, একটি জাতির বৈজ্ঞানিক উত্থান কেবল প্রযুক্তির অগ্রগতিতে নয়, মানুষ ও মননের বিকাশেও নিহিত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০২৪ সালে ISRO সফরের সময় যথার্থই বলেছিলেন—গগনযান অভিযাত্রীদের মধ্যে শুভ্রাংশু শুক্লা “ভারতের মহাকাশে রাষ্ট্রদূত, আমাদের বৈজ্ঞানিক শক্তির প্রতীক।”
তাঁদের ব্যক্তিগত অধ্যবসায় ও অবদান ISRO-র সমষ্টিগত কৃতিত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত, যা আজকের ভারতকে বিশ্বমঞ্চে একজন আত্মবিশ্বাসী মহাকাশশক্তি হিসেবে গড়ে তুলেছে।
শুক্লার এই মিশন শুধু একক অর্জন নয়—এটি ইন্দো-মার্কিন মহাকাশ সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। যেখানে এক সময় ভারত সোভিয়েত অংশীদারিত্বে তার প্রথম মানব মহাকাশ যাত্রা করেছিল, সেখানে আজকের ভারত একটি শক্তিশালী এবং সমান অংশীদার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। এই পরিবর্তন আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের অবস্থান ও বিশ্বাসযোগ্যতার নিঃসন্দেহ প্রমাণ।
বিশ্বব্যাপী দৃষ্টিকোণ থেকেও ভারতের মহাকাশ কর্মসূচি এখন এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। সীমিত বাজেটে চন্দ্রযান-৩ ও মঙ্গলযানের সাফল্য যেমন ইসরোকে গ্রহ অনুসন্ধানে নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছে, তেমনি গগনযান এবং অ্যাক্সিওম-৪ মিশনের মতো মানব মহাকাশ অভিযানের মাধ্যমে ভারত প্রবেশ করছে সেই অভিজাত দেশগুলোর কাতারে, যারা নিজের প্রযুক্তিতে মানুষকে মহাকাশে পাঠাতে সক্ষম।
এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে শুভ্রাংশু শুক্লার উপস্থিতি শুধুমাত্র ভারতের মর্যাদা বৃদ্ধি করছে না, বরং বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও অনুপ্রাণিত করছে—প্রমাণ করছে যে সীমিত সম্পদ দিয়েও অসীম স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
ভারতের এই মহাকাশ অভিযান এখন আর শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক গর্বের নয়—এটি এক সাংস্কৃতিক, কৌশলগত ও বৈশ্বিক আত্মপ্রকাশ। যেখানে শুক্লার মতো মানুষরা হয়ে উঠেছেন সেই নতুন ভারতের দূত, যারা মহাকাশে পা রেখেও মাটির বাস্তবতাকে সঙ্গে করে নিয়ে চলেছেন।
এক উত্তরাধিকার, এক ভবিষ্যৎ, এক মহাকাশ স্বপ্ন
ভবিষ্যতের দিগন্তে তাকালে স্পষ্ট হয়—শুভ্রাংশু শুক্লার অবদান ভারতের মহাকাশ অভিযানের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের পথকে শুধু প্রশস্তই করেনি, বরং তাতে যুক্ত করেছে নতুন গতি ও দৃষ্টিভঙ্গি। গগনযান মিশনকে কেন্দ্র করে তাঁর ভূমিকা ভারতের সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বাস্তব রূপ দিতে সহায়ক, যার মধ্যে রয়েছে ২০৪০ সালের মধ্যে চন্দ্রপৃষ্ঠে একটি অভিযানের পরিকল্পনা এবং নিজস্ব মহাকাশ স্টেশন স্থাপনের লক্ষ্য।
শুক্লার কঠোর প্রশিক্ষণ, কারিগরি দক্ষতা ও সংহত মনোভাব ভবিষ্যতের ISRO প্রকল্পগুলোর জন্য আদর্শ মডেল হয়ে উঠবে। তিনি শুধুমাত্র একজন মহাকাশচারী নন, বরং নতুন প্রজন্মের গবেষক, বৈজ্ঞানিক এবং মহাকাশচর্চাকারীদের পথপ্রদর্শক। গগনযান প্রকল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই উত্তরাধিকার প্রমাণ করে যে ভারত আজ NASA, ESA কিংবা Roscosmos-এর মতো প্রথিতযশা মহাকাশ শক্তিগুলোর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে সক্ষম।
রাকেশ শর্মা থেকে শুভ্রাংশু শুক্লা—এই উত্তরাধিকারের কাহিনি অধ্যবসায়, অগ্রগতি এবং আত্মবিশ্বাসের এক অবিচ্ছিন্ন সূত্র। শর্মার অভিযানে ভারতের মহাকাশযাত্রার দ্বার খুলেছিল, আর শুক্লার গগনযান মিশন সেই দ্বার পেরিয়ে নিজের পথ নিজেই তৈরি করার প্রতীক। তাঁরা একসঙ্গে গড়ে তুলছেন এমন এক জাতীয় চেতনার প্রতিরূপ, যা পার্থিব সীমা মানে না—যা নিরন্তর তারার পানে এগিয়ে চলে অটল সংকল্পে।
রাকেশ শর্মার ১৯৮৪ সালের সেই ঐতিহাসিক যাত্রা ভারতীয় মহাকাশ অভিযানের সম্ভাবনাকে প্রজ্জ্বলিত করেছিল, আর শুভ্রাংশু শুক্লার গগনযান অভিযাত্রা সেই সম্ভাবনার বাস্তব রূপ। একজন পথপ্রদর্শক, অন্যজন পথ নির্মাতা।
এই যাত্রা কেবল প্রযুক্তি বা কৃতিত্বের নয়, এটি এক গভীর জাতীয় চেতনা, বৈজ্ঞানিক প্রজ্ঞা এবং সাংস্কৃতিক আত্মমর্যাদার বহিঃপ্রকাশ। ISRO-র সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, এবং শুক্লার মতো নিবেদিত মহাকাশচারীদের অবদান মিলিয়ে ভারতের মহাকাশ ওডিসি আজ আর কোনো সীমা মানে না—বরং ঘোষণা করে, আকাশের কোন সীমা নেই, তাই এই যাত্রা কেবলমাত্র শুরু।