নিউজ ডেস্ক: বাংলার বুকে রাজনৈতিক পরিবর্তন শেষবার ঘটেছিল ২০১১ সালে। ৩০ বছরের বাম অপশাসনকে শেষ করে বাংলার মদনাদে বসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।সেই সময় থেকেই তিনি রাজ্যের মহিলাদের আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হয়ে ওঠার বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করে চলেছেন। সেই সূত্রে গ্রামের মহিলাদের নিয়ে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন এবং সেই সব গোষ্ঠী যাতে ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ পায় সেই ব্যবস্থা করার দিকেই জোর মুখ্যমন্ত্রী। এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। সূত্র বলছে গত বছর সমীক্ষার ভিত্তিতে স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরীর ক্ষেত্রে প্রথম হয়েছে বাংলা। সেই স্বীকৃতি দিয়েছিল কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদীর সরকারই।
শুধু তাই নয়, বাংলাকে তুলে ধরে কেন্দ্র দেশের সব রাজ্যকেই বার্তা দিয়েছিল যে, নারীর ক্ষমতায়নে তাঁরা যেন বাংলাকেই অনুসরণ করেন। সব থেকে বড় কথা বাংলার এই উন্নয়নের ধারেকাছেও সেই বিজেপি শাসিত কোনও ডবল ইঞ্জিনের রাজ্য। গ্রামীণ উন্নয়ন সংস্থা বা District Rural Development Cell, যাকে অনেকেই DRDC বলে চেনে সেই দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ‘আনন্দধারা’ প্রকল্পের অধীনে বার্ষিক মাত্র ২ শতাংশ হারে ঋণ প্রদান করা হয় স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে। একটি গোষ্ঠী তৈরি হওয়ার ৬ মাস পর পদ্ধতি মেনে তাঁরা ঋণের জন্য আবেদন করতে পারে। নতুন অ্যাকাউন্টে শুরুতেই দেড় লক্ষ টাকা দেওয়া হয়। পরে ঋণের পরিমাণ ধাপে ধাপে বাড়ে। আর এই ভাবেই ঋণ পেয়ে পেয়ে ক্রমেই আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে রাজ্যের মহিলাদের। ঋণ নেওয়ীর পর সেই টাকা ব্যক্তিগতভাবে ভাগ করে কেউ পশুপালন করছেন, কেউ কাপড়ের ব্যবসা করছেন। এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে রাজ্য। স্বনির্ভর হচ্ছেন রাজ্যের মহিলারা।
কীভাবে কাজ করে স্বনির্ভর গোষ্ঠী?
প্রতি গ্রাম পঞ্চায়েতেই তৈরি হয়েছে এই স্বনির্ভর গোষ্ঠী। যে সমস্ত মহিলারা অন্য কোনও চাকরি করছেন তাঁরা ওই গ্রুপের সদস্য হতে পারে। গোষ্ঠীর হাত ধরে সর্বোচ্চ তিন লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ পেতে পারেন। সেই টাকায় করতে পারেন ব্যবসা। অনেকেই আবার নানা ব্যক্তিগত প্রয়োজনেও টাকা পেতে পারেন। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে তা শোধ করে দিতে হয়।
মহিলাদের স্বনির্ভর করতে রাজ্যের ভবিষ্যৎ ভাবনা
রাজ্যের এই সিদ্ধান্তের জেরেই গত ১৩ বছরে বাংলার বুকে ১০ লক্ষ ৭৬ হাজার ৯৩৪টি স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। দেশের মধ্যে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সংখ্যার হিসাবে এখন বাংলাই প্রথম। এবার সেই সংখ্যাকে আরও বাড়িয়ে দিতে চলেছে রাজ্য সরকার। রাজ্যে নতুন করে আরও ৮০হাজার স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে নবান্ন। সবটাই হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে। এর ফলে আরও ৮ লক্ষ পরিবার উপকৃত হতে চলেছেন।
ইতিমধ্যে প্রতিটি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্লক ভিত্তিক টার্গেট পাঠানো হয়েছে। সমষ্টিগতভাবেও মহিলাদের আর্থিক উদ্যোগ তৈরিতে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর বিকল্প নেই। তাই মুখ্যমন্ত্রী মহিলাদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আরও বেশি করে গোষ্ঠী গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। বাংলায় সাধারণ ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের কোনও মহিলা যাতে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর থেকে বাদ না থাকেন সেজন্য গ্রামে গ্রামে সমীক্ষাও করা হয়েছে। এখনও গোটা রাজ্যে প্রায় ৮ লক্ষ মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর আওতার বাইরে রয়েছেন। তাই তাঁদের প্রত্যেককে গোষ্ঠীর আওতায় আনার জন্য’ নতুন করে আরও ৮০হাজার, গোষ্ঠী গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মহিলাদের স্বনির্ভর করতে রাজ্যের অভিনব উদ্যোগ
রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রাম বাংলার মহিলাদেরও উপার্জন বৃদ্ধিতে করা হচ্ছে বিভিন্ন সহযোগিতা। রাজ্য সরকারের পাশাপাশি এবার মল্লারপুর এ নাবার্ড নামে একটি সংস্থা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের এবার ছাগল পালনের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
স্বনির্ভর গোষ্ঠীর একটি গ্রুপে প্রত্যেককে ৩ টি ছাগল দেওয়া হয়েছে ।এখান থেকে মহিলারা ছাগল পালন করে ভাল অর্থ উপার্জন করতে পারবে। ছাগল পালনের জন্য বিনামূল্যে সংস্থার পক্ষ থেকে মনিটরিং থেকে বিনামূল্যে টিকাকরণের ব্যবস্থাও রেখেছে। যাতে সামান্য খরচে ছাগল পালনের মাধ্যমে মহিলারা স্বাবলম্বী হতে পারে তারই লক্ষ্য সংস্থার। নাবার্ড এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে নৈশুভা নামে একটি সংস্থা। শুধু যে মহিলাদের ছাগল এবং মুরগি দেওয়া হচ্ছে সেটা নয় এর পাশাপাশি তাদের লালন-পালনের জন্য একটি ঘর বানিয়ে দিচ্ছে এই সংস্থা।
এই বিষয়ে নইসুভা সংস্থার সাধন সিনহা জানান, বাংলার কালো ছাগল বলে পরিচিতি এই প্রাণী সঠিকভাবে লালন পালন করলে উপভোক্তা উপকৃত হবে। যে কারণে সংস্থার এই উদ্যোগ। মহিলারা নিজেরা স্বাবলম্বী হতে পারবে এই ছাগল চাষ এর ফলে। সংস্থার দাবি, শহর এলাকায় মহিলারা স্বনির্ভর হলেও গ্রাম্য এলাকায় এবং আদিবাসী পাড়া এলাকায় মহিলারা ঠিকভাবে স্বনির্ভর নয়। তাদেরকে স্বনির্ভর করতেই এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অন্য দিকে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর দুইজন মহিলা জানান ছাগল এবং মুরগি পেয়ে তারা অনেকটাই উপকৃত হয়েছেন। এখান থেকে আগামী দিনে আরও ভালো উপার্জনের আশা করছেন মহিলারা। বাড়ির মধ্যে হাজার কাজের ফাঁকে ঠিক ভাবেই লালন পালন করা যায় এই ছাগল এবং মুরগিগুলিকে। তাই তারা সংস্থার এই উদ্যোগে অনেকটাই খুশি।
জেলায় এক লক্ষ মহিলা হবেন ‘লাখপতি দিদি’
নারীর ক্ষমতায়নে নতুন ইতিহাস রচনা করবে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা! ‘লাখপতি দিদি’ তৈরি করতে কোমর বেঁধে নামছে প্রশাসন। লক্ষ্য, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যদের বছরে ন্যূনতম ১ লক্ষ টাকা আয় নিশ্চিত করা। আর এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে একগুচ্ছ পরিকল্পনাও নিয়েছে প্রশাসন।
কী ভাবে তৈরি করা হবে ‘লাখপতি দিদি’?
প্রশাসন জানিয়েছে, একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে কমপক্ষে ১০ জন সদস্য থাকেন। গোষ্ঠীর উদ্যোগী মহিলাদের নানা ভাবে সাহায্য করা হবে। চাইলে তাঁরা মাছ চাষ করতে পারেন, হাঁস-মুরগি পালন করতে পারেন, মৌমাছি পালন করতে পারেন আবার আনাজ কিংবা ধান চাষও করতে পারেন।
ইচ্ছে করলে ছাগল পালন করে ছাগলের বাচ্চাও বিক্রি করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তাঁদের প্রোডিওসার গ্রুপ হিসেবে ধরে সেখান থেকেই সরকার ছানা কিনে অন্য উপভোক্তাদের দেবে। এ ভাবেই একজনের বাৎসরিক আয় হবে বছরে ১ লক্ষ টাকা।
কিন্তু কী ভাবে এই কাজটি সম্ভব হবে?
প্রজেক্ট ডিরেক্টর জানান, ১২০ জন লাখপতি দিদির জন্য একজন করে রিসোর্স পার্সন নিয়োগ করা হবে। যাঁরা নিয়মিত তাঁদের কাছে যাবেন। তাঁরা যে এলাকায় বাস করেন, সেই এলাকার নিরিখে কোন চাষ বা কোন পশু পালন করা সম্ভব, সেগুলো বুঝিয়ে দেবেন।
তারপরে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করানোর পাশাপাশি সেই দপ্তরের অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের দিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করানো হবে। তারপর শুরু হবে প্রকল্পের মূল কাজ। শুধু উৎপাদন করেই শেষ নয়, তাঁদের উৎপাদিত সামগ্রী বিপণনেও সাহায্য করবে প্রশাসন। এ ভাবেই স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যদের ‘লাখপতি দিদি’ করা হবে।
মায়েদের নামে গাছ লাগিয়ে আয় মেয়েদের
গাছ লাগানো ও গাছের পরিচর্যা করে আয় হবে মহিলাদের। মহিলাদের আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর করার লক্ষ্যে কাজ করছে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার। এ বার পরিবেশ রক্ষায় পুরসভা ভিত্তিক সরকারি জায়গায় গাছ লাগানোর ক্ষেত্রেও যুক্ত করা হচ্ছে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের।
‘একটি গাছ মায়ের নামে’ এই কর্মসূচির মাধ্যমে আগামী ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে ব্যাপক ভাবে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সারা দেশ থেকে নির্বাচিত মোট পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গও। রাজ্যের দশটি শহরকে বেছে নিয়ে চলবে গাছ লাগানোর কাজ। ইতিমধ্যেই পুরসভা এলাকায় সরকারি জায়গা চিহ্নিতকরণের কাজ প্রায় শেষ। জায়গা চিহ্নিতকরণ, প্রচার করা থেকে গাছ লাগানোর পর দু’বছর গাছের পরিচর্যা করার জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের। কেন্দ্রীয় সরকারের আম্রুত ২.০ প্রকল্প চালু হয়েছে। এই প্রকল্পেরই একটি আম্রুত মিত্র। পুরসভা এলাকার পার্ক রক্ষণাবেক্ষণ, তদারকি, ওয়াটার মিটার রিডিং ও জলের গুণগত মান পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহের কাজেও যুক্ত করা হয়েছে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের।
স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের মাধ্যমে ব্যাপক ভাবে গাছ লাগানোর এই কর্মসূচিতে আপাতত দেশের পাঁচটি রাজ্যকে যুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং রাজস্থান। এ রাজ্যের ১০টি শহরের মধ্যে রয়েছে ডায়মন্ড হারবার, উত্তর দমদম, দমদম, ইংলিশবাজার, জঙ্গিপুর, বাঁশবেড়িয়া, মধ্যমগ্রাম, কোন্নগর ও নিউ ব্যারাকপুর। এই সমস্ত পুরসভা এলাকার সরকারি জায়গাতেই মূলত গাছ লাগানো হবে।
মধ্যমগ্রাম পুরসভার অধীনে রয়েছে ১২৭১টি স্বনির্ভর গোষ্ঠী। গাছ লাগানোর জন্য তার মধ্যে ২৭টি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাকে যুক্ত করা হয়েছে।ইতিমধ্যেই ন্যাশনাল আরবান লাইভলিহুড মিশন এবং আম্রুত প্রকল্পের নোডাল অফিসার মহিলাদের নিয়ে মধ্যমগ্রামের পার্ক, স্কুল, পুকুর, ডোবা, ক্যানালের মতো সরকারি জায়গা গাছ লাগানোর জন্য চিহ্নিত করেছেন।
মধ্যমগ্রাম পুরসভা এলাকায় ইতিমধ্যেই পঞ্চাশের বেশি জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই সমস্ত এলাকায় গিয়ে গাছ লাগানোর জন্য বাসিন্দাদের কাছে প্রচারের কাজটাও করবেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা। প্রচার এবং চিহ্নিতকরণের কাজ চলতি মাসের মধ্যে শেষ করার পর আগামী ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে ‘একটি গাছ মায়ের নামে’ কর্মসূচিতে ব্যাপক ভাবে গাছ লাগাবেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারাই। রাজ্য সরকারের বিভিন্ন নার্সারি এবং বন দপ্তর থেকে চারা গাছের জোগান দেওয়া হবে। মধ্যমগ্রাম পুরসভার চেয়ারম্যান নিমাই ঘোষ বলেন, ‘আম্রুত ২.০ প্রকল্প কেন্দ্রের হলেও রাজ্যের ১০টি শহরের মধ্যে রাজ্য সরকার মধ্যমগ্রাম পুরসভাকে রেখেছে। এর জন্য পুরসভার পক্ষ থেকে তাদের ধন্যবাদ জানাই।’
পেপার প্লেট তৈরি করেই স্বনির্ভরতার দিশা
অন্যদিকে রাজ্য সরকারের তরফে গ্রামীণ মহিলাদের স্বনির্ভর করার উদ্যোগে বোচাডাঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েত অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছে। উত্তর দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জ ব্লকের বোচাডাঙ্গা গ্রামে প্রান্তিক পরিবারের মহিলারা নিজেদের হাতে তৈরি করছেন কাগজের থালা, প্লেট, গ্লাস আরও কত কী।
আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া এই মহিলাদের স্বনির্ভর করতে ছয় মাস আগে এগিয়ে আসে গ্রাম পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ। পঞ্চায়েতের উদ্যোগেই পাকুরিয়ায় সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট ইউনিটের ক্যাম্পাসে পেপার প্লেট কারখানা গড়ে ওঠে। আর সেখানেই নীতি দেবশর্মা, বুধো দেবশর্মাদের মতো ২২ জন মহিলা কাজ করে স্বনিরভর হয়ে উঠেছেন।
ঠিক যে ভাবে ‘প্যাডম্যান’ ছবিতে বাড়ি বাড়ি স্যানিটারি প্যাড বিক্রি করে মহিলারা সংসারের হাল ধরেছিলেন, এখানেও সে ভাবেই বাড়ির পুরুষের কাছে আর ‘হাত পাততে’ হচ্ছে না অর্ধেক আকাশদের। তাঁদের মুখে ফুটেছে হাসি। বিয়ে কিংবা অন্নপ্রাশন, যে কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে এই মহিলাদের তৈরি প্লেট ব্যবহার হচ্ছে। বারো মাসে তেরো পার্বণ তো রয়েইছে। ফলে একটুও বসে থাকার জো নেই নীতি-বুধোদের।
এখানে কাজ করার অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছিলেন নীতি। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে কাগজের প্লেট তৈরি করছি। স্বামীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও সংসারে সাহায্য করতে পারছি।’ কী ভাবে কাজ হয় এখানে? নীতির কথায়, ‘কেউ পাতা বানায়। কেউ কাজ প্যাকেটজাত করা। কেউ আবার প্যাকেট গুনে বাজারজাত করে।’ কাচামালও তাঁরাই সংগ্রহ করে আনেন। বুধো জানালেন, গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে থালা, গ্লাস, প্লেট বানানোর মেশিন দেওয়া হয়েছে। তাঁর বক্তব্য, ‘গ্রামের সমস্ত অনুষ্ঠান বাড়িতে এখন আমাদের তৈরি সামগ্রী ব্যবহার হচ্ছে।’ যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসারের অনেক খরচ মেটানো যাচ্ছে বলে হাসিমুখে জানান বুধো।
আনন্দধারা প্রকল্প
কেন্দ্রের সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে ঋণদানের নিরিখে (২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে) সারা দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান দখল করে নিল পশ্চিমবঙ্গ। শীর্ষে রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ ৷ রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে সবমিলিয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। এর ফলে রাজ্যের প্রায় ১০ লক্ষ ৩৭ হাজার স্বনির্ভর গোষ্ঠী নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগে অর্থাৎ ২০১০ সালে স্বনির্ভর গোষ্ঠী পিছু রাজ্যে ঋণের গড় পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার টাকা। সেখানে এখন বাংলায় স্বনির্ভর গোষ্ঠী পিছু ঋণের গড় পরিমাণ প্রায় তিন লক্ষ টাকা। সবথেকে বড় বিষয় হল অধিকাংশ স্বনির্ভর গোষ্ঠী মহিলা দ্বারা পরিচালিত হয়।
স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে আর্থিকভাবে আরও শক্তিশালী করে তুলতে চলতি অর্থবর্ষে আনন্দধারা প্রকল্পে ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে সরকার। রাজ্যের প্রতিটি বড় শহরে বিগ বাজার তৈরির পরিকল্পনাও করা হয়েছে রাজ্যের তরফে। কিছুদিন আগেই উত্তরবঙ্গের সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন রাজ্যের প্রত্যেকটি বড় শহরে বিগবাজার তৈরি করা হবে এবং বাধ্যতামূলকভাবে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির জন্য দুটি ফ্লোর রাখতে হবে। সবমিলিয়ে কর্মসংস্থানে নতুন দিশা দেখাচ্ছে এই স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি।
স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে ব্যাপক সাফল্য
মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরির নিরিখে অন্যান্য রাজ্যের থেকে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে বাংলা। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত অনেক মহিলা এক বছরে লক্ষাধিক টাকার বেশি উপার্জন করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সমীক্ষায় এমনই তথ্য উঠে এসেছে। ‘লাখপতি দিদি’র তথ্য পঞ্জি তৈরি করতে গিয়ে এই সমীক্ষা করেছিল কেন্দ্র। তাতে দেখা যাচ্ছে, ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে বাংলা। রাজ্যে মহিলার সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৫ লক্ষের বেশি যারা লক্ষাধিক টাকার বেশি আয় করছেন।
কেন্দ্রীয় সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, কর্ণাটকের মতো ডাবল ইঞ্জিন রাজ্যগুলিকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন বাংলার মহিলারা। প্রসঙ্গত, রাজ্যের মহিলাদের স্বনির্ভরতার উপর জোর দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার জন্য প্রচুর সংখ্যায় স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরির পাশাপাশি তাদের সহজে এবং সুলভে ঋণ প্রদান করারও ব্যবস্থা করছে রাজ্য। কেন্দ্রের ন্যাশনাল রুরাল লাইভলিহুড মিশন প্রকল্পের সাহায্য পাওয়ার পর স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত মহিলাদের জীবনধারায় কতটা পরিবর্তন এসেছে তা জানতে চালানো হচ্ছে এই সমীক্ষা।
জানা গিয়েছে, সমীক্ষার কাজ প্রথম শুরু হয়েছে হুগলি জেলায়। সেখানে এই ধরনের মহিলার সংখ্যা ছাড়িয়েছে একলক্ষের বেশি। এরপরে রয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর, উত্তর এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা এবং নদিয়া জেলা।
পাখির চোখ ২০২৬ বিধানসভা ভোট
রাজ্য জুড়ে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর উন্নয়নে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে রাজ্য সরকার। রাজ্যের একাধিক প্রকল্প স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে করে তুলেছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ বছরের রাজ্য বাজেটেও বরাদ্দ হয়েছে ৭৯৮.৫৭ কোটি টাকা। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প ও আর্থিক সহায়তায় স্বনির্ভর গোষ্ঠী স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে দেশের বুকে উদাহারণ তৈরি করেছে। বাংলার সরকার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের ‘জাগো’ প্রকল্পে শর্তহীন আর্থিক সাহায্য প্রদান করে। আবার মহিলাদের হাতে তৈরি জিনিস ক্রেতাদের কাছে পৌঁছতে নিয়ম করে প্রতিবছর সবলা মেলার আয়োজন করা হয়। সামাজিক সুরক্ষার স্বার্থে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের জন্য সমাজসাথী প্রকল্প, উপজাতিদের জন্য মুক্তিধারা প্রকল্প এবং স্বামী বিবেকানন্দ স্বনির্ভর কর্মসংস্থান প্রকল্পও রয়েছে সেই তালিকায়।
মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি পরিসংখ্যান দিয়ে জানান, আমাদের রাজ্যে এখন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ লক্ষ। অন্য কোনও রাজ্যে তা নেই। চলতি বছরে এখনও পর্যন্ত ১০ লক্ষ ৭৬ হাজার ৯৩৪ স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। এই উন্নয়নের ধারে-কাছেও নেই বিজেপি শাসিত কোনও ডবল ইঞ্জিন রাজ্য। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর উন্নয়নে, বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষমতায়ন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গোষ্ঠীগুলোর আত্মনির্ভরতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে তাঁর সরকার। মহিলাদেরকে স্বনির্ভর করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার রাজ্যে একাধিক প্রকল্প চালু করেছে। শহর এবং গ্রামের মহিলারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের আওতাধীন একাধিক প্রকল্পে কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। কেন্দ্রের রিপোর্ট বলে দিচ্ছে, মালিকানার ক্ষেত্রেও তারা দেশের মধ্যে সবার সেরা। একইসঙ্গে স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করে এই রাজ্যের মহিলারা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আর তা ফুটে উঠেছে কেন্দ্রের রিপোর্টে।