নিউজ ডেস্ক: জরুরি অবস্থার সময় পশ্চিমবঙ্গের যেসব সংবাদমাধ্যম ও ব্যক্তিত্ব সরকারি দমননীতি ও সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন, তাঁদের তালিকা ও কার্যকলাপ তুলে ধরা হলো।
জরুরি অবস্থার সময় বাংলার সংবাদপত্রগুলোর ওপর কী ধরনের সেন্সরশিপ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল?
· সরকারি সেন্সরশিপ জারি করে বলা হয়—প্রতিটি রিপোর্ট আগে সরকারকে দেখিয়ে অনুমতি নিতে হবে।
· ‘প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো’ (PIB)-এর মাধ্যমে খবর যাচাই করে অনুমতি মিলত, অনেক সময় তা একেবারে বাতিল করা হতো।
· রাজনৈতিক খবর, সম্পাদকীয়, এমনকি সাহিত্যও কাটছাঁটের শিকার হয়।
· ‘অস্বস্তিকর’ বা সরকারবিরোধী কিছুই ছাপা চলবে না—এটাই ছিল নির্দেশ।
· অনেক কাগজ বাধ্য হয়ে খবর বাদ দিয়ে ফাঁকা জায়গা রাখে, প্রতিবাদস্বরূপ।
· সাংবাদিকদের কলম আটকাতে MISA আইনে গ্রেফতারও করা হয়।
· রাজনৈতিক খবর নয়, নাট্যজগৎ, সাহিত্য এবং সামাজিক বিশ্লেষণও সেন্সরের আওতায় পড়ে।
কোন সংবাদপত্র প্রথম পাতায় ফাঁকা জায়গা রেখে সেন্সরের প্রতিবাদ করেছিল?
The Statesman (কলকাতা সংস্করণ)
২৬ জুন ১৯৭৫-এ সেন্সরশিপ জারি হওয়ার পরদিন, প্রথম পাতায় রিপোর্ট না ছেপে ফাঁকা জায়গা রেখেছিল।
গৌরকিশোর ঘোষের মুখে কালি দেওয়া ছবি কোন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল?
আনন্দবাজার পত্রিকা
তিনি কলামে লেখেন “আমি আজ থেকে মূক” এবং সেইসঙ্গে ছাপা হয় তাঁর মুখে কালি দেওয়া ছবি—সাংকেতিক প্রতিবাদের দৃষ্টান্ত।
‘Frontier’ পত্রিকা কীভাবে সেন্সরের প্রতিবাদ জানাত?
Frontier (সাপ্তাহিক, ইংরেজি)
সরকারবিরোধী লেখা ছাপাত, অনেকবার নিষিদ্ধ হয়েছিল।
অনেক প্রতিবেদনে লেখা থাকত—“This article could not be published in full” বা “Editor’s Note Withheld”।
কাদের লেখা সবচেয়ে বেশি সেন্সরড হয়েছিল বাংলায়?
· গৌরকিশোর ঘোষ
· উৎপল দত্ত
· মহাশ্বেতা দেবী
· Frontier-এর সম্পাদক সুশোভন সরকার
বাংলার কোন সাহিত্য পত্রিকাগুলো এই সময় প্রাসঙ্গিক প্রতিরোধের মঞ্চ হয়ে উঠেছিল?
· দেশ
· পরিচয়
· Frontier
· প্রগতি
· একতারা
· কৃত্তিবাস
সাহিত্য, গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে তারা সেন্সরের বিরুদ্ধে সাংকেতিক প্রতিবাদ জানায়।
বাংলার সাংবাদিকতা: জরুরি অবস্থায় এক নজরে
বিষয়
তথ্য
সাহসী দৈনিক
আনন্দবাজার, Statesman
সাহসী সাপ্তাহিক
Frontier, পরিচয়
সম্পাদক/লেখক
গৌরকিশোর ঘোষ, সাগরময় ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্ত
প্রতিবাদের রূপ
মৌনতা, ফাঁকা পৃষ্ঠা, সাংকেতিক সাহিত্য, লিটল ম্যাগ
মেইনস্ট্রিম’ সংবাদপত্র এবং লিটল ম্যাগাজিন—তাদের ভূমিকার মধ্যে কী পার্থক্য ছিল?
· মেইনস্ট্রিম পত্রিকা (যেমন আনন্দবাজার, Statesman) সেন্সরের ভয়ে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ না করলেও সাংকেতিক ভাষা ও প্রতীক ব্যবহার করত।
· লিটল ম্যাগাজিন (যেমন Frontier, পরিচয়) তুলনায় সরাসরি প্রতিবাদ করত, গোপনে ছাপা হতো, বারবার বন্ধ করে দেওয়া হতো।
· মূল পার্থক্য—একপক্ষে সতর্ক প্রতিবাদ, অন্যপক্ষে খোলামেলা প্রতিরোধ।তাদের ভূমিকা ছিল অনেকটা আন্ডারগ্রাউন্ড রেজিস্ট্যান্স প্রেস-এর মতো—যেখানে সত্য বলা ছিল বিপজ্জনক কিন্তু অপরিহার্য।
বাংলায় সংবাদমাধ্যম কীভাবে সেন্সরশিপের মধ্যেও রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছে দিত?
এটি ছিল এক সৃজনশীল প্রতিবাদের সময়। সংবাদপত্রগুলো সরাসরি নয়, ইঙ্গিতে কথা বলত। প্রতিবাদী সাংবাদিকেরা ব্যবহারে আনতেন—
· আধা-লিখিত প্রতিবেদন, যেমন: “এই বিষয়ে এখন কিছু বলার নেই”
· সাহিত্যিক গল্প বা কবিতার মধ্যে সরকারের প্রতিকৃতি
· সাংকেতিক শব্দ বা ছদ্মনামে লেখা, যেমন ‘কালো রাজা’, ‘নীরব নগর’—এসব চরিত্র আদতে শাসককে নির্দেশ করত।
· বিদেশি সংবাদপত্র উদ্ধৃতি দিয়ে তথ্য প্রকাশ, যাতে নিজস্ব অবস্থান স্পষ্ট না করেও পাঠকের কাছে বার্তা পৌঁছায়।
এই পদ্ধতিগুলো সাধারণ পাঠকের কাছে স্পষ্ট ছিল, যদিও প্রশাসনের পক্ষে প্রমাণ করা কঠিন।
“The press was asked to bend, but it crawled”—এই বক্তব্য কতটা প্রযোজ্য ছিল বাংলার ক্ষেত্রে?
· এই বিখ্যাত বক্তব্যটি দেন লালকৃষ্ণ আদবানি, ইন্দিরা সরকারের পতনের পর সাংবাদিকদের আত্মসমালোচনার প্রসঙ্গে।
· “The press was asked to bend, but it crawled” জাতীয় স্তরে প্রযোজ্য হলেও, বাংলার চিত্র কিছুটা ভিন্ন।
· অনেক পত্রিকা চুপ ছিল বটে, কিন্তু আনন্দবাজার, Statesman, Frontier বা দেশ পত্রিকা সাংকেতিকভাবে প্রতিবাদ জানায়।
· কেউ কেউ ঝুঁকেছিল, কিন্তু কেউ কেউ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকেও প্রতিবাদ করেছিল।
· বাংলার প্রেক্ষাপটে তাই বলা যায়—সবাই হামাগুড়ি দেয়নি, কেউ কেউ নীরব প্রতিরোধে বিশ্বাস রেখেছিল।
জরুরি অবস্থায় বাংলার সংবাদপত্রগুলোর নীরব/সাংকেতিক প্রতিবাদ
আনন্দবাজার পত্রিকা (Anandabazar Patrika)
ধরণ: নীরব ও সাংকেতিক প্রতিবাদ
উল্লেখযোগ্য ঘটনা:
· সম্পাদকীয় কলামে গৌরকিশোর ঘোষ লিখেছিলেন:
“আমি আজ থেকে মূক। আমি কিছু লিখতে পারছি না।”
– তাঁর মুখে কালি দেওয়া ছবিও ছাপা হয়।
· লেখার মধ্যে হঠাৎ স্তব্ধতা, শেষ না করা বাক্য, “আজ আর কিছু লেখার নেই” ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে সেন্সর ইঙ্গিত করা হতো।
· রিপোর্টে রাজনৈতিক কিছু বাদ গেলে সেটা বোঝা যেত শিরোনাম ও উপশিরোনামের ফাঁকফোকর থেকে।
দ্যা স্টেটসম্যান The Statesman (Kolkata edition)
ধরণ: প্রতীকী প্রতিবাদ
বিশেষ ঘটনা:
· ২৬ জুন ১৯৭৫-এ প্রথম পাতায় ফাঁকা জায়গা রেখে প্রকাশ।
পাঠক বুঝতে পারতেন সেন্সরশিপ কার্যকর হয়েছে।
· রিপোর্টে সরকার সমর্থন না করে নিরপেক্ষ ভাষায় ‘নো-কমেন্ট পলিসি’ নিত, যা নিজেই একটি অবস্থান ছিল।
দেশ পত্রিকা (ABP-র সাহিত্য সাময়িকী)
ধরণ: সাহিত্যিক সাংকেতিক প্রতিবাদ
কৌশল:
· উপন্যাস, কবিতা, গল্পে সরকারি দমন-পীড়ন নিয়ে সরাসরি কিছু না লিখে আবরণে ঢাকা ইঙ্গিতপূর্ণ চরিত্র, উপমা, আখ্যান প্রকাশিত হতো।
· কিছু গল্পের শেষে লেখা থাকত—“এটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক”, যাতে সেন্সরের হাত এড়িয়ে যায়।
· সম্পাদক সাগরময় ঘোষ লেখকদের লেখার মধ্যে সেন্সরের ভাষাকে ‘ফাঁকি’ দিয়ে সত্য প্রকাশ করতে উৎসাহ দিতেন।
Frontier (সাপ্তাহিক, ইংরেজি)
ধরণ: প্রকাশ্য সাহসিকতা + সাংকেতিক রচনার মিশ্রণ
বৈশিষ্ট্য:
· সরকারবিরোধী বক্তব্য ছাপানোর ফলে Frontier বারবার নজরদারির মধ্যে পড়ে।
· বহু লেখায় “Editor’s Note Suspended”, “This article could not be published in full” ইত্যাদি লেখা থাকত।
প্রতিবাদকারী লেখক-সাংবাদিক:
নাম
ভূমিকা
গৌরকিশোর ঘোষ
সম্পাদকীয়তে মৌন প্রতিবাদ, গ্রেফতার হন
বরুণ সেনগুপ্ত
প্রতিবাদী রাজনৈতিক রিপোর্টিংয়ের কারণে চাপ ও সেন্সর ভোগ করেন
সাগরময় ঘোষ
‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে সাহসী অবস্থান
মহাশ্বেতা দেবী
রাজনৈতিক-সামাজিক লেখা সেন্সরড, প্রতিবাদ করেন
শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
কবিতায়/উপন্যাসে সংকেতময় প্রতিবাদ
নবারুণ ভট্টাচার্য (পরবর্তী সময়ে)
জরুরি অবস্থার স্মৃতিকে লেখায় ধরে রাখেন
গৌরকিশোর ঘোষের ‘মূক প্রতিবাদ’ কেমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল পাঠক ও শাসকের মধ্যে?
গৌরকিশোর ঘোষ ছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট। সেন্সরশিপের প্রতিবাদে তিনি এক ঐতিহাসিক প্রতীকী প্রতিবাদ করেন—
তিনি তাঁর কলামে লেখেন,
“আমি আজ থেকে মূক হয়ে গেলাম।”
এই লেখার সঙ্গে ছিল তাঁর মুখে কালি দেওয়া ছবি, যেন সাংবাদিকতার মুখে কালি লাগানো হচ্ছে—এই ছবি বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ে। পাঠকেরা হতবাক হয়েও আনন্দিত হন যে কেউ অন্তত স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিল কীভাবে বাকস্বাধীনতা হত্যা করা হচ্ছে।
সরকার চুপ করে বসে থাকেনি। MISA আইনে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়, জেল হয়। কিন্তু এই প্রতিক্রিয়া আরও বেশি আলোচনার জন্ম দেয়, এবং দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি উঠে আসে। গৌরকিশোর ঘোষ হয়ে ওঠেন মৌন প্রতিরোধের প্রতীক।
‘দেশ’ পত্রিকা বা আনন্দবাজারে প্রকাশিত সাহিত্য রচনার মাধ্যমে কীভাবে জরুরি অবস্থার সমালোচনা করা হতো?
এই সময় সাহিত্যে প্রতিবাদ ছিল এক নিরাপদ আশ্রয়, আবার প্রতিবাদের শক্তিশালী ভাষাও বটে।
‘দেশ’ পত্রিকা, সাগরময় ঘোষের সম্পাদনায়, প্রকাশ করতে শুরু করল এমন গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ—যেগুলো সরাসরি কিছু বলছে না, কিন্তু সংকেতে সরকার, দমননীতি, ভয়, প্রতিবাদ সবই প্রকাশ করছে।
উদাহরণস্বরূপ—
· গল্পে ‘কালো মুখোশধারী শাসক’, ‘মৌন শহরের মানুষ’, ‘নির্বাক সংবাদপত্র’—এসব চরিত্রে উঠে আসত সময়ের প্রতিচ্ছবি।
· অনেক গল্পের শেষে লেখা থাকত—“এই কাহিনী সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবের সঙ্গে কোনো মিল থাকলে লেখক দায়ী নয়।”
এই ‘দায়ী নয়’ বাক্যটাই পাঠকের চোখে হয়ে উঠত প্রতিবাদের ঘোষণা।
আনন্দবাজারে বহু লেখায় ছিল পরোক্ষ রাজনৈতিক রেফারেন্স—যা বোঝার জন্য পাঠকের চিন্তাশক্তিকে সক্রিয় হতে হতো।
সংবাদপত্রের ভাষা, শিরোনাম বা ছবির মাধ্যমে কেমন করে সেন্সর এড়িয়ে বার্তা পাঠানো হতো?
সাংবাদিকরা বুঝেছিলেন—সরকার খবরে কাঁচি চালাতে পারবে, কিন্তু শব্দের চাতুর্য, বাক্য গঠনের ছন্দ, ও ছবির ব্যঙ্গাত্মক ক্ষমতা এত সহজে বন্ধ করা যাবে না।কিছু সাধারণ কৌশল:
মাধ্যম
উদাহরণ
শিরোনাম
“সব ঠিক আছে, তাই সব চুপ!” – এমন ব্যঙ্গাত্মক হেডলাইন
ছবি
কার্টুনে ‘বন্ধ মুখ’, ‘অন্ধfolded বিচার’, অথবা সংবাদপত্রে তালা
ভাষা
বাক্য—“এই বিষয়ে লেখার অনুমতি নেই”, বা “এই প্রতিবেদন পূর্ণাঙ্গ নয়”
ফাঁকা স্থান
কোথাও কিছু ফাঁকা জায়গা, যাতে পাঠক বুঝে যান সেন্সর চলেছে
বিদেশি পত্রিকা কোট
New York Times বা Guardian-এর উদ্ধৃতি ব্যবহার করে ভারতীয় ঘটনার প্রসঙ্গ তোলা
এই প্রতিটি কৌশল পাঠকের জন্য হয়ে উঠত “কোডেড বার্তা”। কেউ কথা বলছে না, তবু অনেক কথা বলা হয়ে যাচ্ছে।
সাংবাদিকদের মধ্যে “স্ব-সেন্সরশিপ” বা আত্মনিয়ন্ত্রণ কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল?
জরুরি অবস্থায় রাষ্ট্রীয় সেন্সরের পাশাপাশি আরেকটি মারাত্মক উপসর্গ দেখা যায়—স্ব-সেন্সরশিপ বা আত্মনিয়ন্ত্রণ।
এটি ছিল এমন এক পরিস্থিতি, যেখানে সাংবাদিক বা সম্পাদক নিজেরাই বুঝে যেতেন কী লেখা যাবে না—লেখার আগেই কেটে ফেলতেন সাহসের অংশটি।
এই স্ব-সেন্সরশিপ হয়েছিল তিনটি কারণে:
1. প্রকাশনার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা: কোনওরকম চ্যালেঞ্জ জানালে হয়তো পুরো কাগজই বন্ধ হয়ে যেত।
2. সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা: রিপোর্টারদের গ্রেফতার হওয়া, নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, এমনকি নির্যাতনের ভয় ছিল সত্যি।
3. ‘অন্য কাগজও তো কিছু বলছে না’—এই মনোভাব: একটা পেশাগত নিঃসঙ্গতা তৈরি হয়েছিল, যেখানে প্রতিবাদ না করাই হয়ে উঠেছিল ‘নতুন স্বাভাবিক’।
এই আত্মনিয়ন্ত্রণ সংবাদমাধ্যমের ভিতরে একটা ভয়-নির্মিত নীরব সংস্কৃতি গড়ে তোলে, যার প্রভাব জরুরি অবস্থার পরেও বহু বছর ছিল।
সব সংবাদপত্র কি সমানভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছিল? না কি কেউ নিরাপত্তার কারণে নীরব থেকেছে?
জরুরি অবস্থার সময় অনেক সংবাদপত্র ও সম্পাদক পুরোপুরি নীরব ছিলেন।
কারণ ছিল—
· প্রকাশনার লাইসেন্স হারানোর ভয়
· সম্পাদক বা রিপোর্টারের গ্রেফতারের আশঙ্কা
· প্রেসে হানা, ছাপাখানা বন্ধ করে দেওয়া ইত্যাদি ঝুঁকি
নীরব সম্পাদক ও প্রকাশক (প্রকাশ্য প্রতিবাদের রেকর্ড নেই):
সংবাদপত্র
সম্পাদক (তৎকালীন)
অবস্থান
যুগান্তর
(নাম নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না; পরিবারভিত্তিক সম্পাদনা)
একেবারে নীরব
নবযুগ
কংগ্রেসপন্থী পরিচালনা পর্ষদ
সরকারঘেঁষা ভাষা
দেশদূত/সমাচার
স্থানীয় সম্পাদক
প্রশাসনিক চাপ এড়িয়ে চুপ
ভারত কেশরী
ধর্মীয় সংগঠনের প্রতিনিধি
রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার আড়ালে নীরবতা
কাদের লেখা সবচেয়ে বেশি সেন্সরড হয়েছিল বাংলায়?
জরুরি অবস্থার সময় বাংলায় যেসব লেখক ও সম্পাদক বারবার সেন্সর বা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
নাম
কারণ
গৌরকিশোর ঘোষ
আনন্দবাজারে মূক প্রতিবাদ—গ্রেফতার হন
উৎপল দত্ত
নাটক নিষিদ্ধ, সরকারবিরোধী রচনার জন্য নজরদারি
মহাশ্বেতা দেবী
আদিবাসী-আন্দোলন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বিষয়ে লেখালেখি
সুশোভন সরকার (Frontier)
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও বামঘেঁষা প্রতিবাদমূলক লেখার জন্য
তাঁদের লেখার একটা বড় অংশ ছাপা যেতে পারেনি, বা ছাপা হলেও সরকারি নজরে পড়ে সরিয়ে দিতে হয়েছিল।
সংবাদপত্রগুলোর নীরবতা কি আপসহীনতা ছিল, না তা ছিল কৌশলগত বেঁচে থাকার পথ?
এই প্রশ্নের উত্তর একরৈখিক নয়। বাংলার সংবাদপত্রের নীরবতা কখনও ভয় ও আপসের ফলাফল, আবার কখনও জীবিত থেকে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কৌশল।
অনেক সম্পাদক-প্রকাশক বুঝেছিলেন—”এখন কিছু বললে হয়তো কিছুই থাকবে না, কিন্তু যদি বাঁচিয়ে রাখা যায়, তাহলে একদিন না একদিন সব বলা যাবে।”
এই চিন্তা থেকেই
· কেউ সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করতেন।
· কেউ সাহিত্যকেই করতেন প্রতিরোধের হাতিয়ার।
· প্রতিবাদ ছিল—শুধু মাটির নিচে, ধোঁয়ার আড়ালে।
মহাশ্বেতা দেবী বা উৎপল দত্তের লেখায় সেন্সরের প্রতিবাদ কেমন প্রতিফলিত হয়েছিল?
জরুরি অবস্থায়, লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী ও উৎপল দত্তের কলম ও নাটক হয়ে ওঠে প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর।
মহাশ্বেতা দেবী তাঁর ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসে রাজনৈতিক বন্দির মায়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে রাষ্ট্রীয় দমননীতির তীব্র সমালোচনা করেন।
উৎপল দত্ত তাঁর নাটক ‘বার্বারিক’, ‘কলঙ্ক মোচন’-এ সরাসরি তুলে ধরেন পুলিশি হিংসা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।
মহাশ্বেতা দেবী:
· তাঁর লেখালেখির ওপর নজরদারি ছিল। আদিবাসী অধিকার, রাষ্ট্রীয় হিংসা ও রাজনৈতিক বন্দিদের নিয়ে লেখার জন্য সরকার তাঁকে “উসকানি দিচ্ছেন” বলে চিহ্নিত করে।
· সরকারি অনুদান ও প্রকাশনার সুযোগ থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়, এবং তাঁর লেখাগুলির ওপর অপ্রকাশিত সেন্সর চাপানো হয়।
· যেসব পত্রিকা ও লিটল ম্যাগে তিনি লিখতেন, সেগুলোর অনেক সময় বিতরণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
উৎপল দত্ত:
· তিনি ছিলেন প্রকাশ্যে রাষ্ট্রবিরোধী নাট্যকার।
· তাঁর নাটক ‘বার্বারিক’, ‘কলঙ্ক মোচন’ ইত্যাদি নাটক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
· বেশ কয়েকটি নাটকের শো বন্ধ করে দেওয়া হয়, পুলিশ পাঠিয়ে মঞ্চে হানা দেওয়া হয়, পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হয়।
· এমনকি, তাঁকে নজরবন্দি রাখা হয়েছিল কিছু সময় এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য অনুমতির প্রয়োজনীয়তা চাপিয়ে দেওয়া হয়।
গোপনে সংবাদ প্রকাশ ও বিতরণের কৌশলসমূহ কী ছিল?
লোকেশন ঘুরিয়ে ছাপা
– বারবার ছাপাখানা বদলানো হতো, যাতে পুলিশ ঠিকমতো নজর রাখতে না পারে।
– কখনও মুদ্রণ অন্য শহরে গিয়ে, কখনও ব্যক্তিগত বাসায় ছাপানো হতো।
FRIEND CIRCULATION MODEL
– বিশ্বাসভাজন পাঠকের মাধ্যমে হাতে হাতে সংবাদপত্র বিলি করা হতো।
– পরিচিতির ভিত্তিতে কপি পৌঁছত নির্দিষ্ট পাঠকের কাছে।
ফটোস্ট্যাট কপি বা টাইপ করা কপি
– মূল পত্রিকার সীমিত সংখ্যা হাতে করে তৈরি হতো,
– পরে ফটোকপি বা টাইপ করা কপি বন্ধুদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হতো।
পোস্টাল কোড নামে গোপন বিতরণ
– ছদ্মনামে পাঠানো হতো কাগজ, খামে লেখা থাকত অন্য নাম বা উদ্দেশ্য।
– ‘Educational Material’ বা ‘Private Letter’ বলে চালানো হতো।
ছদ্মনামে লেখা ও সাংকেতিক ভাষা
– লেখক ও সম্পাদক ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন।
– গল্প, কবিতা বা রম্যরচনার আড়ালে থাকত সরাসরি রাজনৈতিক ইঙ্গিত।
“উৎসব সংখ্যা” বা “বিশেষ সাহিত্য সংখ্যা” আড়ালে রাজনৈতিক লেখা
– সরকারকে বিভ্রান্ত করতে সাহিত্য সংখ্যা বা উৎসব সংখ্যার ছদ্মবেশে প্রতিবাদী লেখা ছাপানো হতো।
বই বা পুস্তিকার মতো করে বিতরণ
– কিছু প্রতিবাদী লেখা সংবাদপত্র নয়, বরং ছোট পুস্তিকার আকারে ছাপিয়ে বিলি করা হতো, যাতে নজরদারি এড়ানো যায়।
জরুরি অবস্থার সময় পশ্চিমবঙ্গ থেকে কতজনকে মিসা আইনে গ্রেফতার করা হয়?
পশ্চিমবঙ্গ থেকে MISA আইনে মোট ৪,৯৯২ জন গ্রেফতার হয়েছেন, যার মধ্যে সাংবাদিক ও লেখকও ছিলেন।
আজকের সাংবাদিকতা-পাঠে ১৯৭৫–৭৭-এর বাংলার সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি?
১৯৭৫-৭৭-এর বাংলা সংবাদমাধ্যম আমাদের শেখায়:
1. সাংকেতিক ভাষাও প্রতিবাদের এক রূপ, যদি তা পাঠকের সঙ্গে এক নৈতিক সংযোগ তৈরি করতে পারে।
2. ভয় আর দায়িত্বের দ্বন্দ্বে দাঁড়িয়ে থেকেও একজন সাংবাদিক নিজের বিবেক বজায় রাখতে পারেন।
3. প্রতিকূলতায় কীভাবে সাংবাদিকতা কৌশলী, সৃজনশীল ও নীতিবান হতে পারে—সেটিই দেখিয়েছে আনন্দবাজার, দেশ, The Statesman, Frontier-এর মতো কাগজ।