নিউজ ডেস্ক: গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে আবারও জলমগ্ন হল পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল, চন্দ্রকোনা এবং গড়বেতার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। যদিও বৃষ্টি থামার পর চন্দ্রকোনা ও গড়বেতার পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে, কিন্তু ঘাটাল এখনও কার্যত জলের তলায়। শত শত বিঘা কৃষিজমি জলের নিচে ডুবে রয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বহু পরিবার। ঘাটালের এমত পরিস্থিতিতে বিধানসভায় উঠল মাস্টার প্ল্যান প্রসঙ্গ। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে কেন্দ্রকে নিশানা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। কতদিন সময় লাগবে তাও স্পষ্ট করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্যদিকে এদিনই ঘাটালের পরিস্থিতি নিয়ে বিজেপি বিধায়ক হিরণ চট্টোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন।
‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’ কী?
ফি বছর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের বিস্তীর্ণ এলাকা। শিলাবতী, ঝুমি ও কংসাবতী নদীর জল বাড়লে ঘাটাল মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে থাকে। রূপনারায়ণ দিয়ে সেই জল বেরিয়ে গেলে সমস্যা কাটে। কিন্তু, তা না হওয়ায় এলাকাবাসী দুর্ভোগের মধ্যে পড়েন। জলের তলায় চলে যায় রাস্তাঘাট। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ত্রাণ শিবির, প্রতিবেশীর পাকা বাড়ির ছাদে আশ্রয় নেন মানুষ। নৌকায় করে চলে যাতায়াত। তার মধ্যে রাত-বিরেতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে বা গুরুত্বপূর্ণ কাজে অন্যত্র যাওয়ার প্রয়োজন পড়লে তো আরেক সমস্যা। সেইসময় কার্যত অসহায় হয়ে পড়েন এলাকাবাসী। শুধু কি তাই ! জল নামলেও শুরু হয় অন্য আতঙ্কে। বিষধর সাপের আনাগোনা বাড়ে। এর পাশাপাশি এলাকায় পানীয় জলের সমস্যা দেখা দেয়। সেই বন্যার প্রভাব কেবল পশ্চিম মেদিনীপুরেই সীমাবদ্ধ থাকে না। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পাঁশকুড়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও তার প্রভাব পড়ে। সেখান থেকেই ৩৯ বছর আগে তৈরি হয়েছিল ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের পরিকল্পনা। যার বাস্তবায়ন এখনও প্রত্যক্ষ করতে পারল না ঘাটালবাসী।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ ও জলপথ বিভাগ পূর্ব মেদিনীপুর এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের ৬৫৭ বর্গকিলোমিটার (বর্গ কিলোমিটার) এলাকার বন্যা মোকাবিলার জন্য একটি সুসংহত পরিকল্পনা তৈরি করেছে, যা বন্যা কবলিত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমা সহ ৮টি ব্লক এবং ২টি পৌরসভা জুড়ে যার বিস্তার।
এই পরিকল্পনার শুরু কোথায়?
পাঁচের দশক, ঘাটালবাসী শুনলেন মাস্টার প্ল্যান আসছে। সে বছরও ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছিল। পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা এমনই বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যে সংসদেও ওঠে ঘাটালের কথা। তার পর থেকে সংসদে বার বার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায় ঘাটাল। পাঁচের দশকে প্রথবার সংসদে ঘাটালের বন্যার সমস্যার কথা তোলেন বাম সাংসদ নিকুঞ্জবিহারী চৌধুরী। এর পরই ঘাটালের বন্যা সমস্যা খতিয়ে দেখতে একটি বিশেষ কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটিই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাব গৃহিতও হয়। ঘাটালবাসী মন্ত্রীর মুখে শুনলেন তাঁদের জন্য ‘মাস্টার প্ল্যানের কথা’। ১৯৫৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের মানসিংহ কমিটি বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে। তার পর নানা কারণে থমকে যায় প্রকল্প।
তার পর ১৯৮৩ সাল। প্রায় কুড়ি বছর পর ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’ প্রকল্পের শিলন্যাস করেন রাজ্যের তৎকালীন সেচ মন্ত্রী প্রভাস রায়। তবে প্ল্যানের অগ্রগতি বলতে ওই শিলন্যাস। আচমকা থমকে গেল তার কাজ। এর পর ফি বছর বছর বন্যায় ভেসে ১৯৯৩ সালে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন ঘাটালের বাসিন্দারা। তাতেও অবশ্য কাজের কাজ কিচ্ছু হয়নি। সেই রাজ্য ও কেন্দ্রের টানাপোড়েন এখনও জারি।
২০০৯ সালে অবশ্য প্রকল্প পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য। ডিটেলস প্রোজেক্ট রিপোর্ট তৈরি শুরু হয়। ২০১০ সালে গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিশনে প্রকল্পের ডিপিআর-ও জমা পড়ে। তার পরের বছরই মাস্টার প্ল্যান সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য চেয়ে ডিপিআর ফেরত পাঠায় কেন্দ্র। ২০১৫ সালে প্রকল্প রিপোর্টে সবুজ সংকেত দেয় কেন্দ্র। কিন্তু তাতেও কাজের কাজ কিছু হয়নি।
কী আছে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানে?
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান মূলত ঘাটালকে ঘিরে থাকা মূল নদী এবং শাখা নদীগুলির নিয়মিত ড্রেজিং করা। যাতে সেগুলির জলধারণ ক্ষমতা বাড়ে এবং বন্যার হাত থেকে ঘাটাল রক্ষা পায়। বলা হয়, পাম্প হাউস তৈরির অনুমোদন চন্দ্রকোনা-ঘাটাল-দাসপুর-সহ পাশ্ববর্তী এলাকায়। নদীপথ সংস্কার করা হবে কংসাবতী ও শিলাবতীতে। স্থানীয় খালগুলিতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ, খাল সংস্কার। সেই সঙ্গে ঘাটালের নদী ও খাল গুলিতে লক গেট বাসানো প্রকল্পের লক্ষ্য।
কী কারণে থমকে মাস্টার প্ল্যান?
দেখতে দেখতে রাজ্যে ৩৪ বছরের বাম শাসন শেষ হয়েছে। ১০ বছরের তৃণমূল সরকার কাজ করছে রাজ্যে। কিন্তু ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়িত হয়নি। ‘১১ সালে অবশ্য সেচমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে এই বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগী হন মানস ভুইঞা। কেন্দ্রীয় সরকারের গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিটিও ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানকে ছাড়পত্র-ও দেয়। প্রাথমিক ভাবে প্রকল্পের বাজেট ঠিক হয়েছিল ২,২০০ কোটি টাকা। কিন্তু গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিটির হস্তক্ষেপের পর সেই বাজেট কমে দাঁড়ায় ১,২৪০ কোটি টাকা। সেই সময়ের নিয়ম অনুযায়ী এই প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ ব্যয়ভার কেন্দ্রীয় সরকারের বহন করার কথা ছিল। বাকি অর্থ দিতে হত রাজ্যকে। কিন্তু পরবর্তী সময় সেই নিয়ম বদলে কেন্দ্র-রাজ্য দুই সরকারের উপরই প্রকল্পের পঞ্চাশ শতাংশ করে খরচের দায়ভার চাপে।
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতোর
এবার ঘাটালের প্লাবিত এলাকা মঙ্গলবার পরিদর্শন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে বিষয়টি নিয়ে তিনি ফেসবুক পেজে লেখেন, “ঘাটালের ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য প্রতি বছর জল যন্ত্রণার মধ্যে পড়তে হয় এই অঞ্চলের মানুষদের। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যানের বাস্তবায়ন জরুরি। সংসদে বারবার সরব হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্র সরকার ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়িত করতে কোনওরকম উদ্যোগ নেয়নি। রাজ্য সরকার দুর্গতদের জন্য প্রশাসনিক সহায়তা সুনিশ্চিত করেছে। এই পরিস্থিতিতে আমি সবাইকে অনুরোধ করব একে অপরের পাশে দাঁড়াতে।” আর বানভাসী ঘাটালে গিয়ে সাংসদ দেব বলেন, মাস্টার প্ল্যান করতে হলে মমতাকে প্রধানমন্ত্রী করাতে হবে।
এদিকে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য, তিনি সেচমন্ত্রী থাকার সময় ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু রাজ্যের ইচ্ছার অভাব রয়েছে। বিরোধী নেতার কটাক্ষ, “মুখ্যমন্ত্রী ১,২০০ কোটি টাকা ইমাম ভাতায় খরচ করতে পারেন। ৭০০ কোটি টাকা ক্লাবকে অনুদান দিতে পারেন। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের জন্য তো ১,২০০-১,৩০০ কোটি টাকা দিতে পারতেন!”
মিমের ছড়াছড়ি
জল-যুদ্ধে জেরবার সাধারণ মানুষ। ভেসে গিয়েছে বাড়ি-ঘর। বুক জলে চলছে নিত্য যাতায়াত। আর তার মাঝেই চলছে রাজনৈতিক তরজা। নতুন সংযোজন হয়েছে মিম। ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’ এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় নতুন হিট কনটেন্ট। তাই ঘাটালবাসীর যন্ত্রণা এখন ইনফ্লুয়েন্সার এবং মিম মেকারদের কাছে ‘ট্রেন্ডিং’। দু’দিন আগেই সুইমিং পুলে সুঠাম চেহারার দেবের ছবি দেখে মুগ্ধ ছিল নেটপাড়া। ঘাটাল বাণভাসী হতেই তাঁকে ঘিরে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা। তৃণমূল সাংসদের ছবি নিয়ে তৈরি হচ্ছে দেদার মিম। অথৈ জলে থাকা ঘাটালের পরিস্থিতি নিয়ে অভিনেতা-সাংসদকে কটাক্ষ চলছে ফেসবুক-ইনস্টায়।
কী জনিয়েছেন দেব?
ঘাটাল মহকুমার ১০৮টি ওয়ার্ড ও অঞ্চলের পরিস্থিতি বেশ ভয়ঙ্কর। ঘাটাল ও চন্দ্রকোনার ২টি ব্লক মিলিয়ে প্রায় ৩০টি ত্রাণ শিবির চলছে। আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় হাজার খানেক বাসিন্দা। বন্যা পরিস্থিতিতে ক্ষোভ জমেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। সমলাচনা বিরোধীদের তরফেও। সাধারণের ক্ষোভের কথা মেনেও নিয়েছেন দেব। তাঁর কথায়, ‘এই দুর্যোগের সময় সরকার এবং প্রশাসন আপনাদের পাশে সব সময় আছে।’ দেব বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি ২০২৫ থেকে কাজ শুরু হয়েছে। এই মাস্টার প্ল্যানের মাধ্যমে নদীর ড্রেজিং থেকে শুরু করে বাঁধ, ব্রিজ, খাল কাটা, খালের সংস্করণ, কৃত্রিম নদী তৈরি করা, জমি অধিগ্রহণ সবই রয়েছে। যার সময়সীমা কমপক্ষে ৪-৫ বছর।’
কোথায় দাঁড়িয়ে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান?
মঙ্গলবার তৃণমূল সরকারের ৯ প্রতিননিধি সাক্ষাৎ করেন কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রী গজেন্দ্র সিং ও নীতি আয়োগের ভাইস চেয়ারম্যান রাজীব কুমারের সঙ্গে। সেই বৈঠক শেষে তৃণমূল খুশি। মানস ভুইঞারা জানাচ্ছেন, এবার সবুজ সংকেত মিলেছে। অপেক্ষায় বানভাসী ঘাটালের মানুষ।
মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সরব মুখ্যমন্ত্রী
ঘাটালের এই পরিস্থিতিতে বিধানসভায় ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের প্রসঙ্গ তুলে, মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সরব হলেন মুখ্যমন্ত্রী। মঙ্গলবার বিধানসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমরা ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান করেছি। দু-তিন বছর সময় লাগবে এই প্রকল্প করতে। কিন্তু, আমরা এটা করবই। কেন্দ্রীয় সরকার ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যানের একটা পয়সাও দেয়নি। আমরা নিজেরাই এই প্রকল্প করছি। এই প্রকল্প করতে গিয়ে জমি নিয়ে যদি কোনও সমস্যা হয়, সাধারণ মানুষের বসবাসে যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, দরকারে প্রকল্পের রুট একটু ঘুরিয়ে দিতে হবে। ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান হয়ে গেলে মেদিনীপুর-সহ বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের বন্যার সমস্যা মিটে যাবে।”
প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি বিজেপি বিধায়ক হিরণের
অন্যদিকে এই পরিস্থিতিতে, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের উল্লেখ ছাড়াই, ঘাটালের বন্য পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিলেন খড়গপুর সদরের বিজেপি বিধায়ক হিরণ চট্টোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন, ঘাটালের বর্তমান পরিস্থিতি খুবই খারপ। পুরো এলাকা বন্যার জলে প্লাবিত। ত্রাণ, নিরাপত্তা এবং পরিকাঠামোর অভাবের কারণে চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে নারী, শিশু এবং বয়স্ক-সহ হাজার হাজার মানুষকে। পর্যাপ্ত এবং দায়িত্বশীলভাবে মানুষের জীবন রক্ষায় কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে রাজ্য সরকার। যে কোনওভাবে সহায়তা করতে হস্তক্ষেপ করুন।
ঘাটালবাসীর অভিযোগ
জলমগ্ন এই ছবি ঘাটালের জন্য নতুন নয়। প্রায় প্রতি বছরই বর্ষা এলেই জল যন্ত্রণার কবলে পড়তে হয় ঘাটালবাসীকে। দীর্ঘদিন ধরে ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’-এর কথা বলা হলেও বাস্তবে তার অগ্রগতি আজও প্রশ্নচিহ্নের মুখে। ঘাটালবাসীর অভিযোগ, প্রতি নির্বাচনের সময় নেতারা প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু বর্ষা এলেই সেই প্রতিশ্রুতি জলেই ভেসে যায়। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় তৃণমূল সাংসদ দীপক অধিকারীর সঙ্গে ঘাটালের মাটিতে দাঁড়িয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন—ঘাটালের বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য মাস্টার প্ল্যান রূপায়িত হবে। কিন্তু আজ ২০২৪ সালেও ঘাটালের বাস্তব চিত্র সেই একই। এ প্রসঙ্গে সেচ দপ্তরের মন্ত্রী মানস রঞ্জন ভুঁইয়া জানান, “এটা শুধু বৃষ্টির জল নয়, ডিভিসি রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা না করেই হঠাৎ জল ছেড়ে দিয়েছে। যার ফলে ঘাটাল, চন্দ্রকোনা ও গড়বেতার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।” তিনি আশ্বাস দেন যে, “ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে রাজ্য সরকার কাজ শুরু করেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, বছরে একবার বৃষ্টি এলেই চাষের জমি জলের নিচে চলে যায়, তাদের রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। পাকা ঘরবাড়ি না থাকায় বহু মানুষকে আশ্রয় নিতে হচ্ছে বাঁধে বা আত্মীয়ের বাড়িতে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে অস্থায়ী ত্রাণশিবির ও খাবারের ব্যবস্থা করা হলেও তা মোটেই পর্যাপ্ত নয় বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। ভোট আসে, ভোট যায়—কিন্তু ঘাটালবাসীর কাছে জল যন্ত্রণা রয়ে যায় এক চিরন্তন অভিশাপের মতো। মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি বহুদিনের, কিন্তু বাস্তবের মাটিতে তার ফল দেখা যাচ্ছে না। তাই প্রশ্ন উঠছে—কবে বাস্তব হবে সেই বহু প্রতীক্ষিত ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’? আর কবে মুক্তি মিলবে জলবন্দি ঘাটালবাসীর?
ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানে জমি জটের সমাধান কী?
এই পরিস্থিতিতে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে বিধানসভায় বিবৃতি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কত সময় লাগবে কাজ শেষ হতে? জমি জট হলেই বা সমাধান কী? তার সবটাই জানালেন তিনি। কেন্দ্রকে দুষে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ”ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান করার কথা অনেক আগে। তা তো করেইনি। আমরাই কাজ শুরু করেছি। ১৫০০ কোটি টাকা খরচ হবে। মানসদা তো কেলেঘাই-কপালেশ্বরী প্রকল্পের জন্য ২০ বার চিৎকার করেছেন। তাও ওরা করে দেয়নি। আমরাই সেই কাজ করেছি। এখনও ঘাটালও করছি। এতে মেদিনীপুরের মানুষের ভালো হবে। বর্ষার সময় আর জলে ভাসতে হবে না। কাজ এগোচ্ছে।” ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জমি সমস্যার অভিযোগ উঠেছে মাঝেমধ্যে। এদিন মুখ্যমন্ত্রী জানালেন, ”জমি নিয়ে সমস্যা তৈরি হলে প্ল্যানটা একটু ঘুরিয়ে দিন, তাহলেই তো মিটে যায়।”
কী জানাল কেন্দ্র?
প্রযুক্তিগত সহায়তা ছাড়া ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণের ব্যাপারে কেন্দ্রের আর কিছুই করার নেই। এখন পুরোটাই রাজ্য সরকারের আওতাধীন। প্রসঙ্গত, এই বন্যা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মসূচি ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের মোট অনুমোদিত বরাদ্দের পরিমাণ ১ হাজার ২৩৮ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকা। এর ৬০ শতাংশ টাকা দেয় কেন্দ্র এবং বাকি ৪০ শতাংশ রাজ্য সরকার বহন করে। অভিযোগ, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে প্রতি বছর বন্যায় প্রায় ১৮ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। পূর্ব এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের ১৩টি ব্লকের ১ হাজার ৬৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। তার পরেও পরিস্থিতি বদলায় না।
২০২৭ সালের মার্চ মাসের মধ্যে শেষ হবে কাজ
স্থায়ীভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং নিষ্কাশন ব্যবস্থার জন্য ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারত সরকারের জলশক্তি, (আরডি এবং জিআর) মন্ত্রকের অধীনে গঙ্গা বন্যা নিয়ন্ত্রণ কমিশন (জিএফসিসি) -এর কাছে কেন্দ্রীয় সহায়তা পাওয়ার জন্য ১২১২ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি বিস্তারিত প্রকল্প প্রতিবেদন (ডিপিআর) জমা দিয়েছে। ২০১৪-২০২২ সময়কালে বিভিন্ন স্তরের মূল্যায়নের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর, ভারত সরকার ১২৩৮.৯৫ কোটি টাকার বিনিয়োগের ছাড়পত্র দিয়েছে ২০২২-এ। পরবর্তী কালে সেচ ও জলপথ বিভাগ ২০২২ সালের জুন মাসে কেন্দ্রীয় তহবিল প্রকল্প FMBAP (বন্যা ব্যবস্থাপনা ও সীমান্ত এলাকা কর্মসূচি) এর আওতায় অন্তর্ভুক্তির আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠায়। তবে, রাজ্য সরকারের গত ১১ বছর ধরে তদ্বির সত্ত্বেও, আজ পর্যন্ত ভারত ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের জন্য কোনও আর্থিক সহায়তার অনুমোদন করেনি।
ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কোনও ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে, রাজ্য সরকার ২০১৮-২০২১ সালে প্রকল্প এলাকায় মোট ১১৫.৮০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ৭টি নদী পুনঃখনন কাজ সম্পন্ন করে, যার মোট ব্যয় ৩৪১.৪৯ কোটি টাকা সম্পূর্ণ রাজ্য সরকারের বাজেট থেকে করা হয়। এছাড়াও, কেন্দ্রীয় সহায়তা প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা বিবে মুখ্যমন্ত্রী চনা করে, রাজ্যের মাননীয়া, ঘাটাল এবং আশেপাশের এলাকার হাজার হাজার বন্যার্তদের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে, প্রকল্পের অবশিষ্ট অংশগুলি নিজস্ব বাজেট থেকে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেন যার মোট ব্যয় বরাদ্দ ১৫০০ কোটি টাকা। এই প্রকল্প ২০২৫-২০২৬ সাল থেকে শুরু করে ০২ (দুই) বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের সময়সীমা স্থির করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মাঠে পাঁচটি স্লুইস নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে, যার বর্তমান অগ্রগতি প্রায় ৬০-৭০%। চন্দ্রেশ্বর খালের খনন কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে।
ঘাটাল পুরসভা এলাকায় দুটি পাম্প হাউসের কাজ শীঘ্রই শুরু হতে চলেছে, কাজের ওয়ার্ক অর্ডার জারি করা হয়েছে। প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের শিলাবতী নদী, পুরাতন কাঁসাই, তমাল, পারং, বুড়ি গঙ্গা, সোলাতোপা, পুরাতন সোলাতোপা চ্যানেলের খননের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। প্রকল্পটি ২০২৭ সালের মার্চ মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।রাজ্যের সেচ মন্ত্রী মানস ভুইয়া জানিয়েছেন, প্রাক্তন সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়ের ভিত্তিহীন দাবির তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে সেচ ও জলপথ বিভাগ। আবারও উল্লেখ করা বাহুল্য যে, গত ১১ বছর ধরে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের জন্য ভারত সরকার এক পয়সাও ছাড় করেনি, যদিও বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ ও জলপথ বিভাগ আত্মবিশ্বাসী যে প্রকল্পের সম্পূর্ণ কাজ শেষ হওয়ার পর, ওই এলাকার মানুষ বন্যা ও জলাবদ্ধতার হাত থেকে মুক্তি পাবে।