নিউজ ডেস্ক: দিঘা জগন্নাথ মন্দির ঘিরে পশ্চিমবঙ্গ রাজনীতিতে ঝড় । বিতর্কের মূল কেন্দ্রবিন্দু – হালাল সাত্ত্বিক ভোগ।
চলতি বছর ৩০ এপ্রিল অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে উদ্বোধন হয় দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের । মন্দিরের দ্বারোদঘাটন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অযোধ্যার রাম মন্দির উদ্বোধনের পর যেমন প্রসাদ বিলি করা হয়েছিল ঠিক সেই আদলে মমতা ঘোষণা করেছিলেন ২৭ জুন রথযাত্রার আগেই রাজ্যের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের প্রসাদ – গজা ও পেঁড়া।
সেই কথা মত ৯ জুন দিঘার জগন্নাথ মন্দির থেকে ৩০০ কেজি মহা প্রসাদ জেলায় জেলায় পাঠানো হয়। জেলাশাসকদের মাধ্যমে বিডিওদের কাছে পৌঁছে যায় ওই মহাপ্রসাদ। সেখান থেকে ব্লকের মিষ্টি দোকানে ওই প্রসাদ থেকে মিষ্টি তৈরির কাজ শুরু হয়। জেলায় সরকার নির্ধারিত মিষ্টি দোকানে তৈরি হয় গজা ও পেঁড়া। এমনকি খাদ্য দফতরের প্রকল্প ‘দুয়ারে রেশন’-এর মাধ্যমে প্রসাদ বিতরণও শুরু হয়ে গিয়েছে। এই পর্যন্ত সব ঠিকই থাকলেও সমস্যা শুরু হয় যখন জানা যায়, ওই ভোগ সরবরাহ করছে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান যারা হালাল সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত এবং মুসলিম মালিকানাধীন। আর তারপরই শুরু হয় বিতর্ক।
BJP-র IT সেল প্রধান অমিত মালব্য মঙ্গলবার (১৭ জুন) মমতা সরকারের তীব্র সমালোচনা করে, এক্স হ্যান্ডেলে একটি পোস্ট করেন, যেখানে দেখা যায়, যে সকল মিষ্টির দোকানকে দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের প্রসাদ তৈরির বরাত দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে তিনটি দোকানের মালিকই মুসলিম। অমিত মালব্য পোস্টের তথ্য অনুযায়ী, এই দোকানগুলির মধ্যে রয়েছে –
1. টিপটপ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার
ঠিকানা – ইসলামপুর, রাণীনগর
মালিক –রাজুশখ
2. ভাই ভাই মিষ্টান্ন ভাণ্ডার
ঠিকানা – ইসলামপুর, রাণীনগর
মালিক – সাবিরুল্লা ইসলাম
3. সোনালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার
ঠিকানা – পাহারপুর, রাণীনগর
মালিক – রজব আলী
প্রত্যেকটি দোকান মুর্শিদাবাদের মতো সংবেদনশীল জেলায় অবস্থিত। বিজেপির অভিযোগ , “এটা শুধু প্রশাসনিক ভুল নয়, এটা ইচ্ছাকৃত উস্কানি।”
হালাল কী?
‘হালাল’ একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ হল—বৈধ বা অনুমোদিত। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী, যেকোনো খাদ্যদ্রব্য বা উপাদান যদি ধর্মীয় নিয়ম অনুসারে প্রস্তুত হয়, তবে সেটিকে হালাল বলা হয়। সাধারণত হালাল পদ্ধতিতে খাবার প্রস্তুতের সময় কিছু নির্দিষ্ট ধর্মীয় মন্ত্র পাঠ করে, নির্দিষ্ট রীতিনীতির মাধ্যমে উপাদান তৈরি ও প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। মূলত এটি মাংসজাত খাদ্যের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলেও এখন অনেক দোকান ও খাদ্য কোম্পানি তাদের মিষ্টি, বিস্কুট, এমনকি প্রসাদ জাতীয় পণ্যেও হালাল সিল লাগাচ্ছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনেকের কাছে এটি গ্রহণযোগ্য নয় কারণ এতে হিন্দু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কোনো ভূমিকা নেই এবং এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মীয় ভাবনার ফলাফল।
সাত্বিক কী?
‘সাত্বিক’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকে। হিন্দু ধর্মে সাত্বিক খাদ্য মানে এমন খাদ্য, যা বিশুদ্ধ, নিরামিষ এবং দেবতাকে অর্পণযোগ্য। এই ধরণের খাবার তৈরি করতে হয় অত্যন্ত পবিত্রভাবে। রান্নার সময় নির্দিষ্ট ধর্মীয় নিয়ম মানতে হয়, যেমন রান্নার সময় কোনো অপবিত্রতা যেন না ঘটে, রান্না করা ব্যক্তির পবিত্রতা রক্ষা করা, ও রান্নাঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। সাত্বিক ভোগে পেঁয়াজ, রসুন বা মাংসজাত কিছুই ব্যবহার করা হয় না। ফলে প্রশ্ন উঠেছে—একটি মুসলিম দোকান যেখানে হালাল প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, সেখানে তৈরি ভোগ কি হিন্দুদের দেবতার কাছে অর্পণযোগ্য সাত্বিক ভোগ হতে পারে?
বিজেপি কী বলছে?
বিজেপির অভিযোগ, এই পুরো বিষয়টি শুধু ধর্মীয় অবমাননা নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিজেপি নেতা অমিত মালব্য বলেন:
“মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করেছেন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে যেখানে অ-হিন্দুদের প্রবেশ নিষেধ, সেখানে বাংলায় জগন্নাথের প্রসাদ হালাল দোকান থেকে কেনা হচ্ছে। এটা সরাসরি হিন্দু ধর্মকে অবমাননা।”
বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারও বলেছেন, “এই ধরনের কাজ ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে সংখ্যালঘু তোষণের রাজনীতির স্বার্থে।”
বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর অভিযোগ, রাজ্য সরকার জগন্নাথ মন্দিরের প্রসাদের নামে স্থানীয় দোকান থেকে মিষ্টি বিতরণ করছে। রাজ্য সরকার তাদের ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্পের মাধ্যমে, যেখানে পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের আওতায় রেশন ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়, সেই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রসাদ বিতরণ করছে।
শুভেন্দু বলেছেন, “সব জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দুয়ারে রেশনের মাধ্যমে প্রসাদ বিতরণ করতে। স্থানীয় মিষ্টির দোকান থেকে কেনা মিষ্টির প্যাকেট বিতরণ করা মূলত হিন্দু ধর্মকে অসম্মান করা।”
তৃণমূলের দাবি কী?
তৃণমূল কংগ্রেস এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন,
“ভগবান সবার, তাই ভোগও সবার জন্য। এখানে ধর্ম দেখে ভোগ তৈরি হয় না। মিষ্টি যারা ভালো বানাতে পারে, তারাই সরকারী টেন্ডার পেয়েছে।”
অন্যদিকে ফিরহাদ হাকিমের বক্তব্য, “এটি ছোট মনের ভাবনা” । তাঁর কথায় , “ভগবান সবার জন্য, তাঁর প্রসাদও সবার জন্য। এই পুরো বিশ্ব ভগবানের সৃষ্টি, আর তাঁর জন্য প্রসাদ যদি হয়, তবে তা সবার জন্য। যারা ইচ্ছুক, তারা গ্রহণ করবে”।
কীভাবে হিন্দু রীতিনীতির লঙ্ঘন করা হল?
জগন্নাথ মন্দিরের ভোগ সাধারণত হিন্দু ব্রাহ্মণ বা সেবায়েতরা সাত্ত্বিক নিয়ম মেনে তৈরি করেন। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রীতি অনুযায়ী:
· মন্দিরের রান্নাঘরে অ-হিন্দুদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
· বাইরের কেউ যদি ভোগ স্পর্শ করে বা নিয়ম না মেনে তৈরি করে, তাহলে তা পূজার জন্য অযোগ্য।
তাই “হালাল” নাম দেওয়া বা অ-হিন্দু ব্যক্তিরা ভোগ তৈরি করা হিন্দু ধর্মের নিয়ম ভাঙার মতো এবং এটা ধর্মীয় আঘাত ।
নাম বিতর্ক: ‘জগন্নাথ ধাম’
আরও একটি বড় বিতর্ক উঠেছে মন্দিরের নাম নিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী মন্দিরটির নাম দিয়েছেন ‘দিঘা জগন্নাথ ধাম’। এই নামকরণকে ওড়িশা সরকার ও পুরীর ধর্মীয় মহল কড়া ভাবে সমালোচনা করেছে। ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘ধাম’ শব্দটি শুধুমাত্র পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের জন্য প্রযোজ্য – এটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। এখানেও প্রশ্ন ওঠে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি ইচ্ছাকৃতভাবেই এই বিতর্ক তৈরি করছেন যাতে হিন্দুদের আবেগে খোঁচা লাগে এবং সেই আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে ভোটের রাজনীতি করা যায়?
এটা কি প্রথমবার?
না, এরকম বিতর্ক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময়ে আগেও ঘটেছে। কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা:
1. দুর্গা বিসর্জন বন্ধ (২০১৬, ২০১৭): মহরম উপলক্ষে রাজ্য সরকার একাধিকবার দুর্গা বিসর্জনের সময়সীমা নিয়ন্ত্রণ করে। অনেক পুজো কমিটিকে বিসর্জনের জন্য নির্দিষ্ট তারিখ ও সময় দেওয়া হয় যাতে মহরমের শোভাযাত্রা বিঘ্নিত না হয়। এই ঘটনায় হিন্দু সমাজে প্রবল ক্ষোভ তৈরি হয়। কলকাতা হাইকোর্টও একবার এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলে, “এটা যেন প্রশাসনের ‘ভাবাবেগ না আঘাত পায়’ নীতির বদলে, একটি ধর্মকে তোষণের দৃষ্টান্ত।”
2. ইমাম ভাতা বিতর্ক: ২০১২ সালে রাজ্য সরকার মুসলিম ইমাম ও মোয়াজ্জিনদের মাসিক ভাতা ঘোষণা করে। এই পদক্ষেপকে নিয়ে প্রবল বিতর্ক তৈরি হয়, কারণ হিন্দু পুরোহিতদের জন্য এরকম কোনও সরকারি সহায়তা ছিল না।
রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তীতে প্রশাসনিক বাধা: একাধিকবার রামনবমী শোভাযাত্রা আয়োজন করতে হিন্দু সংগঠনগুলিকে পুলিশের অনুমতির জন্য সমস্যায় পড়তে হয়েছে, এবং সরকারিভাবে বলা হয়েছে যে এই উৎসবগুলি ‘নতুন করে প্রচলিত’। অথচ অন্য ধর্মীয় উৎসবগুলিতে এমন কড়াকড়ি দেখা যায়নি।
3. CAA বিরোধী আন্দোলনে একতরফা সমর্থন: নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে যে আন্দোলন রাজ্যে চলেছিল, সেখানে মমতা সরকার একতরফাভাবে মুসলিম জনসাধারণের পাশে দাঁড়ায় এবং যেকোনো হিন্দু সংগঠনের মিছিল-সমাবেশ কঠোরভাবে দমন করা হয়।
4. সন্দেশখালি ঘটনাঃ সন্দেশখালিতে একাধিক হিন্দু মহিলা TMC নেতা শেখ শাহজাহানের বিরুদ্ধে জমি দখল , ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির মত অভিযোগ করেন। এই ঘটনা সামনে আসতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ প্রথমে FIR নেয়নি। মুখ্যমন্ত্রী সপ্তাহের পর সপ্তাহ নীরব ছিলেন। ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়। বিক্ষোভকে “সাম্প্রদায়িক উস্কানি” বলা হয়।
5. ২০২৫ সালের মুর্শিদাবাদ অশান্তিঃ ওয়াকফ (সংশোধন) আইন নিয়ে সহিংসতা হয় মুর্শিদাবাদে। হিন্দুদের ঘরছাড়া হতে হয়। তিনজন নিহত, ৪০০-এর বেশি উদ্বাস্তু, মহিলাদের শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে। কলকাতা হাইকোর্ট কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানোর নির্দেশ দেওয়ার পর শান্তি ফিরে। প্রাথমিক পুলিশ প্রতিক্রিয়া ছিল ধীর ও অকার্যকর।
এই সমস্ত ঘটনা একসঙ্গে দেখলে মনে হয়, রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস সংখ্যালঘু তোষণের একটি ধারাবাহিক নীতি অনুসরণ করছে এবং তা করতে গিয়ে হিন্দু ধর্মীয় অনুভূতিকে উপেক্ষা করছে।
একজন সাধারণ মানুষের চোখে প্রশ্নটা সহজ – রাজ্য সরকার যদি প্রকৃত অর্থেই ভক্তিভরে জগন্নাথ দেবের মন্দির তৈরি করে থাকেন, তবে কেন হিন্দু ধর্মীয় রীতিনীতি মানা হল না? কেন মুসলিম দোকান থেকে ভোগ কেনা হলো যেখানে হিন্দু ধর্মে নির্দিষ্ট বিধি-নিষেধ আছে ভোগ প্রস্তুত ও পরিবেশন নিয়ে?
তবে কি এটাই প্রমাণ করে না যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে হিন্দু ধর্মীয় আবেগের থেকে বড় হল ভোটব্যাংক?
এই ঘটনা আবার সেই পুরনো প্রশ্নটা সামনে এনে দিয়েছে – বাংলায় কি ধর্মীয় নিরপেক্ষতার নামে একপাক্ষিক তোষণ চলছে?
যেখানে একদিকে হিন্দু ধর্মের একগুচ্ছ রীতি নিয়মকে ‘পুরোনো’ বলে বাতিল করা হয়, সেখানে অন্য ধর্মের কোনও কিছুর বিরোধিতা করা মানেই ‘সাম্প্রদায়িক’ তকমা। এই দ্বিমুখী নীতি কি সত্যিই ধর্মনিরপেক্ষতা, না এটা রাজনৈতিক সুবিধার নেওয়ার কৌশল?
বহু রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন সামনে রেখে এই সমস্ত পদক্ষেপ মূলত মুসলিম ভোট টার্গেট করে তৈরি। ‘দিঘা ধাম’ হোক বা ‘হালাল ভোগ’, সবই এক নির্দিষ্ট ভোটব্যাংককে খুশি রাখতে গৃহীত পদক্ষেপ।
ধর্ম নিয়ে রাজনীতি নতুন কিছু নয়। কিন্তু যখন তা একপাক্ষিক হয়ে যায়, তখন তা বিপজ্জনক। একসময় যেভাবে কংগ্রেস মুসলিম তোষণের অভিযোগে বিপর্যস্ত হয়েছিল, ঠিক সেই একই পথে হাঁটছে আজকের তৃণমূল কংগ্রেস। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি সেই একই ভুল করছেন প্রশ্নটা জাগছে সাধারণ মানুষের মনে।
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সময় দেবে। তবে আজকে বাংলার মাটিতে ধর্মীয় আবেগ আর রাজনৈতিক হিসেবনিকেশ যেভাবে গুলিয়ে যাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যৎ যে শান্তিপূর্ণ নয় – তা বলাই যায়।