নিউজ ডেস্ক: ৫০ বছর আগে, ১৯৭৫ সালে ২৫ জুন জরুরি অবস্থার ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। গণতন্ত্রের এক আঁধার অধ্যায়ে প্রবেশ করেছিল দেশ। কেড়ে নেওয়া হয়েছিল নাগরিকদের স্বাধীনতা-অধিকার। প্রতিবাদ করলেই শাস্তিস্বরূপ বন্দি করে রাখা হত কালকুঠুরিতে। ইমার্জেন্সি বা জরুরি অবস্থার সেই দিনগুলি কেমন ছিল, তার স্মৃতিচারণ করলেন আরএসএসের প্রচার প্রমুখ সুনীল অম্বেকার।
ইমার্জেন্সির অন্ধকার অধ্যায়
সম্প্রতি দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারির ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। আজ থেকে ঠিক ৫০ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল। সেইসময় ২১ মাস ধরে (২৫ জুন, ১৯৭৫ থেকে ২১ মার্চ, ১৯৭৭) দেশে জরুরি অবস্থা জারি ছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ ভারতের “অভ্যন্তরীণ গোলযোগ” এর কারণে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। এটি ছিল ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত সময়।
সংবিধানের ৩৫২ অনুচ্ছেদের অধীনে এই জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। জরুরি অবস্থার সময়, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার স্থগিত করা হয়েছিল এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সহ বিভিন্ন স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছিল। জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রধান কারণ ছিল “অভ্যন্তরীণ গোলযোগ”, যা ইন্দিরা গান্ধী সরকারের বিরোধিতাকারীদের দমন করার জন্য একটি অজুহাত হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
ইমার্জেন্সির প্রেক্ষাপট
১৯৭৫ সালের ২৫শে জুন রাতে ইন্দিরা গান্ধী ইমার্জেন্সি ঘোষণা করেন। এর পেছনে মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের দমন করা এবং নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা। এর আগে এলাহাবাদ হাইকোর্ট একটি রায়ে ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনী জালিয়াতি প্রমাণিত করে, ফলে তাঁর প্রধানমন্ত্রী পদ খারিজ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি ইমার্জেন্সি ঘোষণা করেন।
কেন আরএসএস ছিল সরকারের নিশানায়?
আরএসএস একটি হিন্দু সমাজসেবী ও সাংগঠনিক প্রতিষ্ঠান। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার মনে করত, আরএসএস সরকারবিরোধী এবং তাদের প্রভাব বাড়ছে। তাই ইমার্জেন্সির সময় সরকার আরএসএসের ওপর কড়া নজর দেয় এবং তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
জরুরি অবস্থার স্মৃতিচারণ সুনীল অম্বেকারের
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি অখিল ভারতীয় প্রচার প্রমুখ সুনীল অম্বেকার বলেন, “ইমার্জেন্সির সময় আমি খুব ছোট ছিলাম..আমরা শাখায় (আরএসএসের ব্রাঞ্চ) খেলতাম। জরুরি অবস্থা ঘোষণা হওয়ার পর স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ওই সময়ে আমরা ভেবেছিলাম যে ইমার্জেন্সি হয়তো এমন কিছু যা বাচ্চাদের খেলাধুলো থেকে আটকায়। আমরা ভাবতাম, কীভাবে সরকার এমন করতে পারে? পরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা অনেক কিছু বুঝতে পারলাম…” জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর কী হয়েছিল, তার স্মৃতিচারণ করে সুনীল অম্বেকার বলেন, “ইমার্জেন্সির সময় আরএসএস কর্মীদের জেলবন্দি করে রাখা হত, তাদের অত্যাচার করা হত। কাউকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হত, অমানবিক অত্যাচার করা হত, যা বর্ণনার বাইরে। ইমার্জেন্সি ঘোষণার সময়ই বহু সংঘসেবকদের গ্রেফতার করা হয়েছিল।”
তিনি আরও বলেন, “ইমার্জেন্সি যেদিন শেষ হয়, আমার মনে আছে সংঘের বাইরে জমা হয়েছিলেন। তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিচ্ছিলেন যে কী কী অত্যাচার করা হয়েছে তাদের উপরে। গণতন্ত্র বাঁচাতে গিয়ে সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতারাই জেলে গিয়েছিলেন। তারপরও তাদের মনোবল ভাঙা যায়নি। দেশে গণতন্ত্র থাকুক, এই দাবিতে তারা অনড় ছিলেন।”
আরএসএস-এর ভূমিকা
আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ) হল একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন, যা সমাজসেবা ও সাংস্কৃতিক কাজে যুক্ত। তবে এই সংগঠন অনেক সময় সরকারের সমালোচনা করত এবং রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিল, বিশেষ করে কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে। ইমার্জেন্সি ঘোষণার পর আরএসএস সরকারবিরোধী কার্যকলাপের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। তারা ইন্দিরা গান্ধীর স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে রাস্তায় নামতে শুরু করে। ফলে সরকার আরএসএস-এর উপর কঠোর পদক্ষেপ নেয়। এই সময় সংবিধানিক অধিকার স্থগিত থাকায় কেউ আইনি পথে প্রতিকার চাইতে পারতেন না। অনেক আরএসএস নেতাকে গোপনে আটক রেখে নির্যাতনও করা হত। কেবল আরএসএস নয়, অন্যান্য বিরোধী দল, সংবাদপত্র এবং স্বাধীন মতপ্রকাশকারী ব্যক্তিদেরও একইভাবে দমন করা হয়।
আরএসএস কর্মীদের ওপর অমানবিক অত্যাচার
ইমার্জেন্সির এই সময়কালে প্রায় ২১ মাস ধরে পুরো দেশজুড়ে গণতন্ত্র প্রায় স্থগিত ছিল। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়, বিরোধীদের জেলে ভরে দেওয়া হয় এবং সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার বাতিল করা হয়। এই কঠিন সময়ে সবচেয়ে বেশি যে সংগঠনটি অত্যাচারের শিকার হয়েছিল, তা হল আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ)।
কী ধরনের অত্যাচার হয়েছিল?
ইমার্জেন্সির সময় আরএসএসের হাজার হাজার কর্মী ও নেতা বিনা কারণে গ্রেফতার হন। তাঁদের ওপর চালানো হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। অনেকে দীর্ঘদিন ধরে জেলে থাকেন, যেখানে খাবার, বিশ্রাম বা চিকিৎসারও ঠিকমতো ব্যবস্থা ছিল না।
বিভিন্ন জায়গায় আরএসএস শাখাগুলি পুলিশ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। সভা-সমাবেশ, মিছিল বা শিক্ষা কার্যক্রম কিছুই চালাতে দেওয়া হয়নি। যাঁরা গোপনে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁদেরও ধরে নিয়ে গিয়ে নানাভাবে হেনস্থা করা হয়।
ইমার্জেন্সির সময় আরএসএস কর্মীদের জেলবন্দি করে রাখা হত
১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি এদেশের গণতন্ত্রের এক কালো অধ্যায়। অনেকে জেল খেটেছেন, এলাকাছাড়া হয়েছেন। সেসময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির কাছে আরএসএস প্রধান পাঠিয়েছিলেন আপসবার্তা। স্বাধীনতা সংগ্রামের মতো জরুরি অবস্থা-বিরোধী আন্দোলনেও সঙ্ঘের ভূমিকা আসলে এক বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস।
জরুরি অবস্থার সময় সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণকারী মোট ১,৩০,০০০ সত্যাগ্রহীর মধ্যে ১০০,০০০ এরও বেশি ছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সদস্য। মিসার অধীনে কারাবন্দী ৩০,০০০ জনের মধ্যে ২৫,০০০ জনেরও বেশি ছিলেন সংঘের সদস্য। জরুরি অবস্থার সময়, ১০০ জন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ কর্মীকে বলি দেওয়া হয়েছিল, যাদের বেশিরভাগই বন্দী অবস্থায় এবং কিছু বাইরে ছিল। সংঘের সর্বভারতীয় ব্যবস্থাপনা দলের প্রধান শ্রী পাণ্ডুরঙ্গ ক্ষীরসাগর তাদের মধ্যে ছিলেন।
গোপনে আন্দোলন চালিয়ে যায় আরএসএস
যদিও সংগঠনটিকে ব্যান (নিষিদ্ধ) করা হয়েছিল, তবুও আরএসএস তাদের কার্যকলাপ থামায়নি। তারা গোপন মিটিং, পুস্তিকা ছাপানো, ও সংগঠনের নেটওয়ার্ক ধরে রাখা ইত্যাদি কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। এই সময় তারা জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
ইমার্জেন্সির অবসান ও আরএসএস-এর পুনরাবির্ভাব
১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী ইমার্জেন্সি প্রত্যাহার করেন এবং সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেন। এই নির্বাচনে কংগ্রেস হেরে যায় এবং জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসে। এর ফলে কারাগারে থাকা বহু আরএসএস কর্মী মুক্তি পান এবং সংগঠন আবার স্বাভাবিকভাবে কাজ শুরু করে।
ইমার্জেন্সির সময় আরএসএস কর্মীদের জেলবন্দি করে রাখার ঘটনা ভারতের গণতন্ত্রে এক কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। এই সময় গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো খর্ব হয়েছিল এবং সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রমাণ দেখা যায়। আরএসএস সহ বহু সংগঠন ও ব্যক্তি এই সময় প্রতিবাদ করে নিজেদের মতপ্রকাশের অধিকার ফিরিয়ে আনার লড়াই চালিয়েছিল।