নিউজ ডেস্ক: আরএসএস—রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ। ভারতীয় উপমহাদেশে অন্যতম বৃহৎ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ২০২৫ সালে শতবর্ষ উদযাপন করতে চলেছে আরএসএস । ১৯২৫ সালে নাগপুরে গড়ে ওঠা এই সংগঠন এক সুদূরপ্রসারী রোডম্যাপ তৈরি করেছে, যার লক্ষ্য আগামী ২৫ বছরে ভারতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নিরাপত্তার কাঠামোকে নতুনভাবে নির্মাণ করা। সম্প্রতি সংঘের সরসংঘচালক ড. মোহন ভাগবত একটি সাক্ষাৎকারে সংঘের আগামী ২৫ বছরে রূপরেখা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তাঁর কথায়, এই রূপরেখার মূল ভিত্তি হবে – জাতীয় ঐক্য, সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা, আত্মরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সামাজিক রূপান্তর। চলতি বছরের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হওয়া আখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভা (এবিপিএস)-এর বার্ষিক সন্মেলন চলাকালীন ২৫ বছরে রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করেন সঙ্ঘ প্রধান। ভাগবতের মতে, আরএসএস আগামী ২৫ বছরের জন্য তিনটি স্তরে কাজ করবে—সামাজিক সংহতি, নৈতিক পুনর্জাগরণ এবং বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তার।
ফিরে দেখা ইতিহাস
১৯২৫ সালে নাগপুরে কেশব বালিরাম হেডগেওয়ারের হাতে যাত্রা শুরু করেছিল এই সংগঠনটি। স্বাধীনতা আন্দোলনের এক ভিন্নধারার অংশ হিসেবে হিন্দু সমাজে একতার বার্তা নিয়ে তৈরি হয়েছিল আরএসএস। তখন থেকেই মূল লক্ষ্য ছিল—ভারতীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয়ের ভিত্তিতে একটি আত্মবিশ্বাসী জাতি গঠন। আজ, শতবর্ষের প্রাক্কালে সেই উদ্দেশ্য আরও বিস্তৃত, আরও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে উঠছে।
ভবিষ্যতের রূপরেখা: ত্রিস্তরীয় কৌশল
ভাগবতের কথায় , আরএসএস আগামী ২৫ বছরের জন্য তিনটি স্তরে কাজ করবে—সামাজিক সংহতি, নৈতিক পুনর্জাগরণ এবং বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তার। এই তিনটি স্তরের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করেছে সংগঠনটি।
১. সামাজিক সংহতি: জাতপাত, ভাষা, অঞ্চল—সব বিভাজনের উর্দ্ধে উঠে
সাম্প্রতিক সময়ে আরএসএস বারবার বলছে—“হিন্দু” বলতে কেবল ধর্ম নয়, বরং একটি “সভ্যতা-চিন্তা”। এই ধারণাকে সামনে রেখে তারা ভারতীয় সমাজের বিভিন্ন স্তরে, বিশেষ করে গ্রামীণ ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে চাইছে। এ জন্য আরএসএস বহু জায়গায় নতুন শাখা খুলছে, যুব ও ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে স্থানীয় স্তরে কাজ করছে।
২. নৈতিক পুনর্জাগরণ: “ধর্মীয় বিপ্লব” নয়, “মানবিক মূল্যবোধের বিপ্লব”
মোহন ভাগবতের ভাষায়, “আজ পৃথিবী একটি নতুন বিপ্লবের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। কৃষি, শিল্প ও বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ইতিমধ্যেই হয়ে গিয়েছে। এবার প্রয়োজন একটি ধার্মিক বিপ্লব—যেখানে সত্য, পবিত্রতা, সংযম ও করুণার ভিত্তিতে মানবজীবন গড়ে উঠবে।”
সঙ্ঘ প্রধান ব্যখ্যা করেছেন , “ধর্মীয়” শব্দটি তিনি ব্যবহার করলেও এর মানে রীতিনীতি নয়—বরং মানবিক মূল্যবোধ।তিনি আরও বলেছেন, আধুনিক বিশ্ব আজ নৈতিকতার সংকটে ভুগছে, আর সেই সংকট থেকে মুক্তির পথ দেখাতে পারে ভারতীয় সভ্যতা ও তার চিন্তাধারা।
৩. বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তার: ‘সংঘ মডেল’ বিশ্বমঞ্চে
মোহন ভাগবতের মতে, আগামী ২০–৩০ বছরের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আরএসএস-এর মতো সংগঠন গড়ে ওঠার সম্ভাবনার রয়েছে । ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু দেশে ভারতীয় অভিবাসীদের মধ্যে আরএসএস-ঘনিষ্ঠ সংগঠন কাজ করছে। এবার আরএসএস সরাসরি এই বৈশ্বিক সম্প্রসারণকে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গ্রহণ করছে।
২০৪৭ লক্ষ্য: বিকশিত ভারত ও নতুন বিশ্বদর্শন
স্বাধীনতার ১০০ বছর পূর্ণ হবে ২০৪৭ সালে। ভাগবতের কথায়, “আরএসএস চায় ১০০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ভারত একটি নৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিতে পরিণত হোক। কেবল অর্থনৈতিক বা সামরিক নয়, বরং একটি নতুন “সমাজ-দর্শনের” ধারক হিসেবে ভারতের আত্মপ্রকাশ ঘটুক। এই লক্ষ্যেই সংঘ কাজ করছে শিক্ষা, সমাজসেবা, গ্রামীণ উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক সচেতনতামূলক কার্যক্রমে ।
পরিবর্তন তাৎক্ষণিক হয় নাঃ মোহন ভাগবত
বিগত ১০০ বছর ধরে সংঘ ধীরে ধীরে নিজের জায়গা তৈরি করেছে। তারা সবসময় বলেছে—“পরিবর্তন রাতারাতি আসে না।” তাই তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তা বা রাজনীতি নয়, আরএসএসের নজর আগামী প্রজন্ম ও শতবর্ষপূর্তির পরবর্তী ভবিষ্যতের দিকে।
নেতৃত্ব তৈরির পেছনে জোর
ভবিষ্যতের এই দীর্ঘ পথচলার জন্য সংঘ জোর দিচ্ছে নতুন নেতৃত্ব তৈরি ও আদর্শচর্চায়। সংঘের প্রশিক্ষণ শিবির, ‘শাখা’ সভা, ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে তারা নতুন প্রজন্মকে হিন্দু সংস্কৃতি ও মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টায় করছে বলে জানিয়েছেন মোহন ভাগবত।
ভারতীয় সমাজের ভবিষ্যৎ রূপরেখা
শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আরএসএস ভারতের সমাজ বদলের একটি নৈতিক রূপরেখা তৈরি করছে। যেখানে পরিবার, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি—সব স্তরে ভারতীয় মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে এক নতুন জাতি গড়ে তোলা হবে বলে মত সরসংঘচালক ড. মোহন ভাগবতের।