নিউজ ডেস্ক: ১৯৪৫ সালে ১৫ অগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করেছিল৷ যদিও, তা একটি পরিপূর্ণ ভারত ছিল না৷ বর্তমান ভারতের যে মানচিত্র, তা পরিপূর্ণ রূপ পেয়েছিল বেশ কয়েক বছরের চেষ্টায়৷ কারন দেশভাগের সময় নদীয়া ও উত্তর দিনাজপুর জেলার কিছু অংশ ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা পেলেও, কিছু অংশ পরে, অর্থাৎ ১৮ই আগস্ট ভারতের অংশ হয়। নদীয়া জেলার ক্ষেত্রে, ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক জারী একটি ঘোষণার মাধ্যমে ১৮ই আগস্ট এই জেলার কিছু অংশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। অন্যদিকে, উত্তর দিনাজপুর জেলারও কিছু অংশ, বিশেষ করে বালুরঘাট মহকুমা, ১৮ই আগস্ট স্বাধীনতা লাভ করে। এই কারণে, এই দুটি জেলার মানুষ ১৮ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে। তারপর থেকে দিনটি যথাযথ মর্যাদায় উদযাপন করা হয়৷ যদিও দিনটি সরকারি ভাবে এখনো পালন করা হয় না।
বিস্তারিত
১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়, নদিয়া জেলার কিছু অংশ এবং অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট মহকুমা (যা পরে উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় বিভক্ত হয়) ১৮ই আগস্ট ভারতভুক্ত হয়। এই কারণে, এই অঞ্চলগুলির মানুষ ১৫ই আগস্টের পরিবর্তে ১৮ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে। র্যাডক্লিফ রোয়েদাদের কারণে এই জেলাগুলির কিছু অংশ, যেমন নদীয়ার মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, এবং মালদা, দিনাজপুর ও জলপাইগুড়ির কিছু অংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
পরবর্তীতে, এই অঞ্চলের মানুষ ও রাজনৈতিক কর্মীরা এই বিভাজনকে চ্যালেঞ্জ করে আন্দোলনে নামেন এবং অবশেষে ১৮ই আগস্ট এই অঞ্চলগুলি ভারতের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।
নদীয়া জেলা: ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট দেশ বিভাগের সময়, নদিয়া জেলার কিছু অংশ (যেমন- শিবনিবাস, শান্তিপুর ও রানাঘাটের কিছু অংশ) পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে, ১৮ই আগস্ট এই অংশগুলি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। তাই, এই অঞ্চলের মানুষ ১৮ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস পালন করে।
বালুরঘাট: বালুরঘাটও একই কারণে ১৮ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস পালন করে। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট যখন ভারত স্বাধীন হয়, তখন বালুরঘাট ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অংশ। ১৮ই আগস্ট এটি ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।
অন্যান্য অঞ্চল: পশ্চিমবঙ্গের মালদা, মুর্শিদাবাদের কিছু অংশ এবং উত্তর চব্বিশ পরগণা ও দক্ষিণ দিনাজপুরের কিছু গ্রামেও ১৮ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়।
কী ঘটেছিল আসলে?
ভারতের বিভাজনের সময় মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার ভারতের দুই ভাগ করে — ভারত ও পাকিস্তান। এই বিভাজনের জন্য র্যাডক্লিফ লাইন নামে একটি সীমান্তরেখা তৈরি করা হয়। তবে এই রেখা ঘোষণার আগে থেকেই পূর্ববঙ্গে (বর্তমানে বাংলাদেশ) ও পশ্চিমবঙ্গের বিভাজন নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু র্যাডক্লিফ কমিশন তাদের সীমান্তরেখা চূড়ান্ত ঘোষণা করে ১৭ অগস্ট ১৯৪৭।
এর ফলে যা হয়:
১৫ অগস্টে ভারত স্বাধীন হলেও, বহু মানুষ জানতেন না তাঁরা কোন দেশের অন্তর্ভুক্ত — ভারত না পাকিস্তান।
নদিয়া ও বালুরঘাট তখন র্যাডক্লিফ লাইনের বিভাজন নিয়ে অনিশ্চয়তায় ছিল।
১৫ অগস্টে নদিয়া ও বালুরঘাটকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
কিন্তু যখন ১৭ অগস্ট র্যাডক্লিফ লাইন চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করা হয়, তখন স্পষ্ট হয় এই অঞ্চলগুলো ভারতের অংশ।
কীভাবে এল ১৮ অগস্ট?
র্যাডক্লিফ লাইন ঘোষণার পর, ১৮ অগস্ট ১৯৪৭ সালে নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, তেহট্ট, করিমপুর সহ অনেক এলাকা ও দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট শহর ভারতবর্ষে সংযুক্ত হয়। এর ফলে, এই অঞ্চলের মানুষ প্রকৃত স্বাধীনতা পায় ৩ দিন পরে।
কী ছিল মানুষের অবস্থা?
এই তিনদিন নদিয়া ও বালুরঘাটের মানুষ এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলেন। কেউ জানতেন না তাঁরা ভারতের নাগরিক নাকি পাকিস্তানের। পুলিশের পোশাক, প্রশাসন, অফিস কিছুই ঠিকঠাক কাজ করছিল না। মানুষের মনে ভয়, দুশ্চিন্তা ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল।
কেন এই ঘটনা এতদিন অবহেলিত?
ভারতের মূলধারার ইতিহাসে ১৫ অগস্ট স্বাধীনতা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু নদিয়া ও বালুরঘাটের এই বিশেষ পরিস্থিতি অনেকদিন ধরে আলোচনার বাইরে ছিল। স্থানীয় স্তরে এটি স্মরণ করা হলেও জাতীয় ইতিহাসে খুব কম গুরুত্ব পেয়েছে।
রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকায় ১৮ অগস্ট পালিত হয় স্বাধীনতা দিবস, কারণ জানেন?
১৫ অগস্ট গোটা ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করলেও ম্যাপে কিছুটা ভুলের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় নদিয়ার শান্তিপুর, রানাঘাট, কৃষ্ণনগর, কৃষ্ণগঞ্জ সহ বিস্তীর্ণ এলাকা। এরপর ১৮ অগস্ট নদিয়া ও বালুরঘাটের বৃহৎ অংশকে ভারতবর্ষের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করার হয়।
স্থানীয়ভাবে দক্ষিণ দিনাজপুরের সদর শহরে একে ‘বালুরঘাট দিবস’ বলা হয়ে থাকে৷ আবার নদিয়া জেলার নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর, শান্তিপুর, রানাঘাট, শিবনিবাস ও কল্যাণীতে এই দিনটিকে ‘অন্তর্ভুক্তি দিবস’ হিসেবে উদযাপন করা হয়৷ উল্লেখ্য, সেসময় বালুরঘাট-সহ দক্ষিণ দিনাজপুরের কিছু এলাকা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নাকি, ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবে, তা নিয়ে কিছুটা সংশয় তৈরি হয়েছিল৷ অধুনা পশ্চিম দিনাজপুর বর্তমানের দক্ষিণ দিনাজপুর ও উত্তর দিনাজপুর এবং মালদা ও নদিয়ার কিছু অংশ তখন পূর্ব পাকিস্তান না ভারতে থাকবে, তা ঠিক হয়নি৷ এই এলাকাগুলি ‘নোশনাল এরিয়া’ বা ‘ধারণাকৃত এলাকা’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল৷ সেখানে ১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলিত হয়েছিল, যা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল, ওই অঞ্চলের মানুষের মধ্য৷ তার জেরে ১৮ অগস্ট অবিভক্ত দিনাজপুর ও নদিয়াকে ভারতের অংশ করা হয়৷
কে ছিলেন পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র?
পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র ছিলেন একজন বিশিষ্ট আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ। তিনি ছিলেন কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে সক্রিয়ভাবে ভারতের স্বার্থে কাজ করে গিয়েছেন। দেশভাগের সময় তিনি ছিলেন ভারতের সংবিধান সভার সদস্য।
পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্রর ভূমিকা
অন্যদিকে, নদিয়া জেলার বিস্তীর্ণ অংশকে ভারতে অন্তর্ভুত করতে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র৷ তিনি ছিলেন ৪০-এর দশকে ভারতের তিন পণ্ডিতদের মধ্যে একজন৷ প্রথমে ব়্যাড ক্লিফ যে মানচিত্র এঁকেছিলেন, তাতে ক্ষুব্ধ হন তিনি৷ লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র দিল্লি গিয়ে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে বোঝান, নবদ্বীপ, শান্তিপুর-সহ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এবং বৈষ্ণবকূল চূড়ামণি অদ্বৈত আচার্যের স্মৃতি বিজড়িত নদিয়া জেলাকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে৷ তা না হলে বৈষ্ণব সম্প্রদায় বিলুপ্ত হয়ে যাবে৷ অবশেষে, ১৭ অগস্ট ঘোষণা হয় নদিয়া জেলা ভারতের অংশ হবে৷ তারপর ১৮ অগস্ট সকালে নদিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ভারতীয় তেরঙা উত্তোলন করা হয়৷
১৯৪৭ সালে শান্তিপুরে প্রথম ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন কবি করুণানিধান বন্দোপাধ্যায়। এরপর থেকে এই দিনটি স্বাধীনতা দিবস পালন করে আসছে নদিয়ার শান্তিপুর এলাকার মানুষজন। সেই মোতাবেক শান্তিপুরে এ দিন পতাকা উত্তোলন করেন শান্তিপুরে বিধায়ক ব্রজ কিশোর গোস্বামী। তবে শুধু নদিয়া নয়, এর পাশাপাশি উত্তরের জেলা দক্ষিণ দিনাজপুরের সদর বালুরঘাট স্বাধীন হয়েছিল এ দিন। সরকারি ভাবে ১৮ অগস্ট বালুরঘাট স্বাধীন হয়েছে এই ঘোষণা করা হয়। তারপর থেকে দিনটি যথাযথ মর্যাদায় উদযাপন করা হয়৷
পণ্ডিত লক্ষ্মীকান্ত মৈত্র শুধুমাত্র একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না — তিনি ছিলেন নদিয়ার রক্ষক। তাঁর বুদ্ধিমত্তা, সাহস এবং মানুষকে ভালোবাসার মানসিকতা আজও আমাদের প্রেরণা দেয়। আমরা যদি আজ নদিয়া জেলাকে ভারতের অংশ হিসেবে দেখে থাকি, তবে তার পেছনে এই মহান ব্যক্তির অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।