নিউজ ডেস্ক: জঙ্গলের নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে গর্জে উঠেছিল স্বাধীনতার দাবিতে এক প্রবল বজ্রধ্বনি। সিধু ও কানু মুর্মুর নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল সাঁওতাল হুল বিদ্রোহ। ভারতের ইতিহাসে এটি ছিল প্রথম বৃহৎ জনজাতি গণজাগরণ, যেখানে প্রতিবাদের ভাষা ছিল মাটি, লাঠি আর আত্মবিসর্জনের শপথ।
জমিদার-মহাজনের শোষণে বিপর্যস্ত জনজাতিদের জীবন। জমি হারানো, ঋণের ফাঁস, আর পুলিশের দমন—এই হুল বিদ্রোহ ছিল সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক জ্বলন্ত প্রতিবাদ।
ইতিহাস
১৮৫৫ সালের ৩০ জুন সিধু মুর্মু ও কানু মুর্মুর (সিধু-কানু) ডাকে ইংরেজদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সাঁওতাল যুবকরা। নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে যা ভারতে প্রথম সশস্ত্র ও সঙ্ঘবদ্ধ লড়াই। শুরুর দিনে প্রায় ১০ হাজার থেকে ক্রমে ধারে-ভারে-কলেবরে ২০ গুণ বেড়েছিল যে সংগ্রাম। প্রায় সাত মাস ধরে যে লড়াই চলেছিল। ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জ জেলার ভাগনাদিহির মাঠে যে লড়াইয়ে শুরু। যা বিহারের ভাগলপুর লাগোয়া। কেউ কেউ বলেন তৎকালীন বিহারের ভাগলপুর ও বাংলার মুর্শিদাবাদের একাংশে বিদ্রোহের সূত্রপাত।ইংরেজের পাশাপাশি স্থানীয় জমিদার ও মহাজনরা সাঁওতালিদের ওপর চালানো জোর-জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সম্প্রদায়ের তরুণদের রুখে দেওয়ার ডাক দিয়েছিলেন সিধু-কানু (Sidho-Kanhu)। তাঁদের সমবেত হতে বলেছিলেন এক জায়গায়। সেখানেই হকের দাবি ছিনিয়ে নিতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার ডাক দিয়েছিলেন আদিবাসী বীর সন্তানরা। শুধু সাঁওতালিদের প্রতিবাদই নয়, ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র এই সংগ্রাম পথ দেখিয়েছিল স্বাধীনতার লড়াইয়ে।
‘হুল, হুল’ আওয়াজ তুলে সাঁওতালিদের যে বিদ্রোহ ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল ইংরেজের মনে। ৩০ জুনের সমাবেশের সপ্তাহ খানেক পরেই দারোগা মহেশ লাল দত্তকে খুন করেছিলেন সিধু। তারপর যা ছড়িয়ে পরে। চাঁদ ও ভৈরবের নেতৃত্বে মুর্শিদাবাদের দিকে এগিয়ে ইংরেজদের ওপর হামলা নামিয়ে আনে তাঁরা। যদিও সেই অভিযানে অনেক মহিলা-শিশুরও মৃত্যুর দায় চাপানো হয় অভিযানের ওপর। যে ঘটনা জানার পর সিধু-কানু তাঁদের ভাইদের কড়া শাসন করেছিলেন বলেও শোনা যায়।সাঁওতালদের বিদ্রোহ রুখতে ইংরেজ সেনাবাহিনীকে পুরোদস্তর শক্তি প্রয়োগ করতে হয়েছিল। ইংরেজদের গুলিতে সিধু মারা যান। ফাঁসি দেওয়া হয় কানুকে। শেষমেশ প্রায় মাসসাতেক পর সাঁওতালরা পরাজিত হলেও আত্মসমর্পণ করেননি। বলা ভাল, ভারতের স্বাধীনতা ইতিহাসের পথে এক লড়াইয়ে নিশান রেখেছিলেন। সেই ঘটনাক্রমে স্মরণ করেই ৩০ জুন পালন করা হয় হুল দিবস। ঝাড়খণ্ডের পাশপাশি পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া জেলাতেও যা পালিত হয়।
এই বজ্রকণ্ঠ স্লোগানেই সাঁওতালরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল দখলদার ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে।পরবর্তীতে এই বিদ্রোহ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে—
সাঁওতালদের প্রতিটি কুঠার, প্রতিটি তীর হয়ে ওঠে এক আত্মমর্যাদার ঘোষণা।হাজারো সাঁওতাল শহিদ হন, কিন্তু রেখে যান বীরত্ব, আত্মত্যাগ আর অধিকারচেতনার এক অমর সংজ্ঞা—যা আজও অনুপ্রেরণা দেয় সংগ্রামী ইতিহাসকে।
একটি ভূখণ্ড যা স্বীকৃতি দেয় আদিবাসী আত্মপরিচয়কে।আর হুল বিদ্রোহ হয়ে ওঠে ভবিষ্যতের মুক্তির লড়াইগুলোর প্রথম আগুন। সিপাহী বিদ্রোহ থেকে গণআন্দোলন পর্যন্ত,সাঁওতালদের সেই গর্জন আজও ইতিহাসের বুকে প্রজ্জ্বলিত এক অধ্যায়।