নিউজ ডেস্ক: হাজার হাজার মাইল দূরে লন্ডনের ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ১৯৪৭ সালের ৫ জুলাই গৃহীত এক আইন বদলে দিয়েছিল উপমহাদেশের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য।
এটি শুধুমাত্র একটি আইন ছিল না—এটি ছিল অবিরাম চলতে থাকা ঘড়ির কাঁটা, যার টিক টিক শব্দ ঘোষণা করছিল স্বাধীনতা আসতে আর বেশি বিলম্ব নেই।তবে তার প্রতিধ্বনি মিশে যাচ্ছিল বিভাজন, বেদনা ও রক্তাক্ত বাস্তবতায়।
এই আইন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের কালিমালপ্ত অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘোষণা করলেও… ইতিহাসের সবচেয়ে বেদনার্ত অধ্যায় হিসেবেও চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।
শুধুমাত্র একটি আইন—যা আমাদের স্বাধীনতা এনে দিল ঠিকই, কিন্তু ফাটল ধরাল আমাদের মানচিত্র, ঘরবাড়ি-সেইসঙ্গে আমাদের হৃদয়েও।
এই আইনটি আসলে কী ছিল?
১৯৪৭ সালের ৫ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাশ হয় The Indian Independence Act—যে আইন দুই শতকের ঔপনিবেশিক শাসনের পর ভারতবর্ষের ভাগ্যে টেনে দেয় এক চূড়ান্ত আইনি রেখা, যা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শেষ সিলমোহর।
আইনটি কার্যকর হয় ১৫ আগস্ট, জন্ম দেয় নতুন দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের—ভারত ও পাকিস্তান।তবে এই আইন কোনও সদিচ্ছা বা শুভেচ্ছার ফসল ছিল না।
এটি ছিল আতঙ্ক ও চাপের কারণে ব্রিটিশ সরকারের এক তড়িঘড়ি প্রস্থান পরিকল্পনা—যার খসড়া তৈরি হয়েছিল শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাব অনুযায়ী এবং তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলির নেতৃত্বে।এই আইন পাশের সঙ্গে সঙ্গেই উপমহাদেশে শুরু হয়ে যায় বিভাজনের এক রক্তাক্ত অধ্যায়—যার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে জনজীবনের প্রতিটি প্রান্তে।
এই আইনটিতে ঠিক কী ছিল?
এতে মোট সাতটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা অন্তর্ভুক্ত ছিল:
১। ভাগের সূচনা: ব্রিটিশ ভারতকে ভাগ করে গঠিত হয় দুটি ডোমিনিয়ন: ভারত ও পাকিস্তান। পাঞ্জাব ও বাংলাকে ধর্মীয় রেখায় ভাগ করা হয়, যা ছিল বিভাজনের সবচেয়ে রক্তাক্ত অধ্যায়গুলির একটি।
২। সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম: ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে উভয় দেশকে দেওয়া হয় পূর্ণ আইনপ্রণয়নের অধিকার এবং স্বাধীন শাসন কাঠামো গঠনের ক্ষমতা।
৩। ব্রিটিশ আধিপত্যের অবসান: ৫৬০টিরও বেশি দেশীয় রাজ্য ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার অধীনে থাকা বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হয়। তাদের উপর থেকে ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব প্রত্যাহার করা হয়।
৪। রাজ্যগুলির স্বাধীন সিদ্ধান্তের অধিকার: দেশীয় রাজ্যগুলি চাইলে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, পাকিস্তানে যোগ দিতে পারে অথবা স্বাধীন থাকারও সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
৫। ‘ভারতের সম্রাট’ উপাধি বিলুপ্তি: ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ‘Emperor of India’ উপাধির ইতি ঘটে; যা ছিল ঔপনিবেশিক দম্ভের এক প্রতীকী পতন।
৬। স্বাধীন আইন কাঠামো প্রতিষ্ঠা: ব্রিটিশ সংসদের আইন তখন থেকে ভারত বা পাকিস্তানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রযোজ্য থাকবে না। উভয় রাষ্ট্র নিজের আইন নিজের মতো করে প্রণয়ন করতে পারবে।
৭। অস্থায়ী প্রশাসনিক কাঠামো: স্থায়ী সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তান পরিচালিত হবে Government of India Act, 1935-এর সংশোধিত রূপ অনুযায়ী।
স্বাধীনতা এল—কিন্তু কোন মূল্যে?
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট—মধ্যরাত।
যখন জওহরলাল নেহরুর কণ্ঠে উচ্চারিত হয় সেই ঐতিহাসিক ভাষণ “Tryst with Destiny”, তখন ভারতবাসী আনন্দে উদ্বেল।
স্বাধীনতার সূর্যোদয় উদযাপিত হচ্ছিল মোমবাতির আলোয়, পতাকা উড়িয়ে, উল্লাসের হর্ষধ্বনিতে… কিন্তু ওই একই সময়ে, আরেক ইতিহাস লেখা হচ্ছিল রক্ত দিয়ে।
একটি স্বাধীনতা, যার পেছনে লুকিয়ে ছিল কোটি কোটি মানুষের কান্না, বিচ্ছেদ, হাহাকার আর হিংসার বিভীষিকা।
দেড় কোটিরও বেশি মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হন—পাকিস্তান থেকে হিন্দু ও শিখরা ভারতে পাড়ি জমান, আর ভারতীয় মুসলিমরা রওনা হন পাকিস্তানের দিকে।
ট্রেন এসে থামে, কিন্তু যাত্রীদের বদলে নেমে আসে নিথর দেহ এবং শবের স্তূপ।
জ্বলে ওঠে শত শত গ্রাম, ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় হাজার হাজার পরিবার—চিরতরে।
প্রায় দশ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারান—একটি ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, যা আজও উপমহাদেশের বুকে জ্বলন্ত ক্ষতচিহ্ন হয়েই রয়ে গিয়েছে।
এই আইন বলবতের পরেও ভারত বেছে নেয় ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের পথ, আর পাকিস্তান রূপ নেয় একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে।
যে টু-নেশন থিয়োরি বিভাজনের আদর্শ হিসেবে কাজ করেছিল, তার বীজ থেকে জন্ম নেয় দুঃখের ফল—যা আজও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে রয়ে গিয়েছে অমীমাংসিত বিরোধ, সীমান্ত উত্তেজনা, ও আস্থার সংকট হিসেবে।