শুভশ্রী রায় চৌধুরী ও পঙ্কজ বিশ্বাস
১৯৬৫ আর ১৯৭১’এ হেরেও লজ্জা হয়নি পাকিস্তানের। দু’বার ভারতের কাছে পরাজিত হয়েও ফের ভারতের ওপর চড়াও হয় পাকিস্তান। সালটা ১৯৯৯। কাশ্মীর দখলের আশা নিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান পারভেজ মুশারফের নেতৃত্বে পরিকল্পিতভাবে লাইন অফ কন্ট্রোল (LOC) লঙ্ঘন করে সাদা পোশাকে ভারতে প্রবেশ করে সশস্ত্র পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নর্দার্ন লাইট ইনফেন্ট্রি। কার্গিল দখল করে ভারতের উপর অতর্কিত হামলা শুরু করে তারা। শত্রুপক্ষকে পরাস্ত করতে কার্গিল সীমান্তে প্রায় ৩০ হাজার জওয়ান মোতায়েন করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। তাদের মধ্যে একজন বাংলার বীর “ক্যাপ্টেন কণাদ ভট্টাচার্য”।
কলকাতার টালার বাসিন্দা কণাদ। ছোট থেকে শান্ত স্বভাবের ছিলেন তিনি। বাবা ইনকাম ট্যাক্সে চাকরি করতেন। মা গৃহবধূ। ছোটবেলা থেকে পড়াশোনায় যথেষ্ট ভাল ছিলেন তিনি। ছিলেন প্রতিবেশী এবং বন্ধুদের বড় স্নেহের। কোনওদিন কারোর সঙ্গে বাদানুবাদে জড়াননি কণাদ। তবে অদম্য জেদ ছিল তাঁর। আর সেই জেদের বসে কলেজের গণ্ডি পেড়িয়ে হঠাৎ করে একদিন সেনাবাহিনী যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।
সেনাবাহিনীতে যোগদানের প্রথম আবেদনপত্র ভুল হয়ে যায় কণাদের। কিন্তু তিনি তো থেমে যাওয়ার মানুষ ছিলেন না। ফের একবার চেষ্টা করলেন ‘বাবু’। হ্যাঁ, এটাই ছিল তাঁর ডাকনাম। তবে এবার সফলতা এল তাঁর। সকলের খানিক অমতে ২২ বছর বয়সে সেনাবাহিনী যোগ দিলেন কণাদ। আসলে ছোটবেলা থেকে অ্যাডভেঞ্চারাস ছিলেন তিনি। হলিউডের বিভিন্ন অ্যাকশন সিনেমা পছন্দ ছিল তাঁর। শুধু তাই নয়। ক্যারাটেতে ব্ল্যাক বেল্ট জিতেছিলেন কণাদ।
সেনাবাহিনী যোগদানের পরও বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল ক্যাপ্টেনের। নিয়ম করে চিঠি লেখা, ফোনে কথা বলা সবই বজায় রেখেছিলেন তিনি। এমনকি পাঞ্জাব রেজিমেন্টের হয়ে কার্গিলে মোতায়েন হওয়ার ঘটনাটিও ফোন করে প্রিয় বন্ধুকে জানিয়েছিলেন কণাদ। এমনকি, বাড়ি এলে বন্ধুদের সঙ্গে সেনাবাহিনীতে তাঁর অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতেন তিনি।
কার্গিলে যাওয়ার আগে দিদির বিয়েতে বাড়ি এসেছিলেন কণাদ। বন্ধুদের নিয়ে আনন্দ করেন তিনি। জানান ফিরে এসে আবার দেখা হবে। কিন্তু জীবনে প্রথমবার সেকথা রাখতে পারেননি কণাদ। মাত্র ২৫ বছর বয়সে বন্ধু, পরিবার সব ছেড়ে কার্গিলে শত্রুপক্ষের দিকে বন্দুক হাতে এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। শত্রুদের গুলিতে ঝাঝড়া হয়ে গিয়েছিল তাঁর শরীর। কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন পরিবারের সকলে। কিন্তু তাঁর শেষযাত্রার সেদিনের সেই দৃশ্য আজও ভোলেননি তাঁর প্রতিবেশী।
কার্গিলের যুদ্ধে আত্মবলিদান দেন কণাদ। বন্ধুদের কাছে সব ঘটনাই যেন ‘এইতো সেদিনের ঘটনা’। তবে কনাদ না থাকলেও তাঁর স্মৃতিতে তৈরি টালা ফ্রেন্ডস্ অ্যাসোসিয়েশনের ‘কনাদ ভবন’ এখনও রয়েছে। তাঁর স্মৃতিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে থাকে তাঁর ক্লাবের সদস্যরা। আজও অবিকল দাঁড়িয়ে কনাদের বাড়ি। যেই বাড়িতে ছোট থেকে বড় হয়েছিলেন আর্মির ক্যাপ্টেন। সেই বাড়িটি আজ হাত বদল হয়েছে। তবে যিনি কিনেছেন তিনি ওই বাড়িতে একরত্তি বদল করেন নি।
৫২৭ জন বীরের আত্মবলিদানের মাধ্যমে অবশেষে ২৬ জুলাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জয় ছিনিয়ে নিয়েছিল ভারত। জয়ী হয়েছিলেন কণাদও।