নিউজ ডেস্ক: এই পথ যদি না শেষ না সেই হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলতো! রুপোলি পর্দা তখন আসলেই রুপোলি ছিল। সাদা কালো স্ক্রিন জুড়ে তখন ঠিকরে পরত ম্যাজিক! যেমন তেমন ম্যাজিক নয়, এ হল উত্তম ম্যাজিক। সাধারণ পাজামা পাঞ্জাবি কিংবা শার্ট-প্যান্ট, যেকোনো লুকেই শুধুমাত্র তাঁর ভুবনমোহন হাসিতে কুপোকাত হতেন বাঙালি নারীরা। সত্তরের দশকে বাংলায় বোধহয় তাঁর মতো আর কোনো সুপুরুষ ছিলেন না। তিনি মহানায়ক, বাঙালির একান্তই নিজের উত্তমকুমার। রবিবার সেই কিংবদন্তির জন্মদিন!
১৯২৬ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর, উত্তর কলকাতায় নিজের মামার বাড়িতে জন্ম হয় অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়ের। পৈতিৃক ভিটে ছিল ভবানীপুরে। চলচ্চিত্র জগতে পা দেওয়ার পর খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার আড়ালে ঢেকে যায় সেই নাম। জন্ম হয় উত্তম কুমারের। তবে উত্তম কুমার হয়ে ওঠার যাত্রা সুখকর ছিল না। কাব্যিক ছন্দে বললে বলা যায় এ ছিল মধ্যবিত্ত বাঙালির আকাশ ছোঁয়ার গল্প। সংসারের হাল ধরতে পড়াশোনা শেষ না করেই চাকরি নেন কলকাতা বন্দরে। প্রথম জীবনে কেরানির চাকরি করতেন তিনি। কিন্তু অভিনয়ের নেশা ছিল প্রবল। সেই থেকেই অভিনয়ে আসা।
১৯৪৮ সালে তাঁর প্রথম ছবি ‘দৃষ্টিদান’ মুক্তি পায়। যদিও ফ্লপ হয় সেই ছবি। এই ছবিটিতেই একমাত্র নিজের পিতৃদত্ত নাম ব্যবহার করেছিলেন তিনি। এর পর ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত পরপর সাতটি ছবিতে কাজ করেন তিনি। তার মধ্যে ১৯৫১ সালে প্রথমবার সহযাত্রী ছবিতে নিজের নাম পাল্টে রাখেন উত্তম কুমার। কিন্তু পরপরই সাতটি ফল্প ছবি হওয়ায় ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যঙ্গ করে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল ফল্প মাস্টার জেনারেল। একসময়ে অভিনয় ছেড়ে বন্দরের চাকরিটাই পাকাপাকি ভাবে করবেন বলে ঠিক করে ফেলেন তিনি। সেসময়ই ভাগ্য দেবী প্রসন্ন হন। ১৯৫২ সালে মুক্তি পায় বসু পরিবার। সে ছবিতেই দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। আর তার পরের ছবি সাড়ে চুয়াত্তর মুক্তি পায় ১৯৫৪ সালে। সাড়ে চুয়াত্তরের সাফল্যের পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। বাঙালি পায় তাঁদের মহানায়ককে। যার নামটুকুই যথেষ্ট ছিল হল হাউসফুল করার জন্য। বাড়ির মহিলাদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন স্বপ্নপুরুষ।
১৯৫৪ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত চলে স্থায়ী ভাবে বাংলা ছবিতে নিজের আসন পাকা করার দৌড়। এ সময়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবিগুলি হল ‘সবার উপরে’, ‘শাপমোচন’, ‘শিল্পী – হারানো সুর’, ‘পথে হল দেরী’, ‘সপ্তপদী’, ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘বিপাশা’, ‘জীবন তৃষ্ণা’,’সাগরিকা’, ‘গৃহদাহ’ ইত্যাদি। জুটি বেঁধেছিলেন সুচিত্রা সেন, সাবিত্রী চ্যাটার্জী, সুপ্রিয়া দেবী সহ আরও অনেক অভিনেত্রীদের সঙ্গে।
৬০-এর দশকে টালিগঞ্জ স্টুডিয়ো পাড়ায় একছত্র শাসন চালিয়ে যান উত্তম কুমার। এই সময়তেই হয়ে ওঠেন বাংলার সর্বকালের সেরা মেগাস্টার। একের পর এক হিট ছবি উপহার দেন ইন্ডাস্ট্রিকে। ৬০ দশকের অন্যতম সেরা ছবিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘শহরের ইতিকথা’, ‘সপ্তপদী’, ‘ঝিন্দের বন্দী’, ‘দেয়া নেয়া’, ‘ভ্রান্তি বিলাস’, ‘জতুগৃহ’, ‘থানা থেকে আসছি’, ‘রাজদ্রোহী’, ‘শঙ্খবেলা’ প্রভৃতি। ‘ঝিন্দের বন্দী’ ছবিতে তিনি প্রথমবার কিংবদন্তি সৌমিত্র চ্যাটার্জির বিপরীতে অভিনয় করেন। তাঁর কর্মজীবনে একাধিক গুণী পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছিলেন তিনি। ‘নায়ক’ ছবিতে প্রথমবার সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করেন তিনি।
১৯৪৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত টানা অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। উত্তম কুমার তাঁর চলচ্চিত্র জীবনে বহু পুরস্কার পেয়েছেন। যার মধ্যে পাঁচবার জাতীয় পুরস্কার, আটবার বিএফজেএ পুরস্কার (যা দ্বিতীয় সর্বাধিক) ও তিনবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৭৫ সালে মহানায়ক উপাধি পান উত্তম কুমার। কলকাতা শহরের বুকে টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের নামও তাই তাঁর নামকরণে মহানায়ক উত্তম কুমার রাখা হয় পরবর্তী কালে। ১৯৮০ সালে মাত্র ৫৩ বছর বয়সে অকাল প্রয়াণ ঘটে অভিনেতার। ৯৭তম জন্মবার্ষিকীতেও বাঙালির মননে চিরসবুজ ‘অতি উত্তম’!