নজিরবিহীনভাবে রাজ্যে লোকসভা ভোটের
দিনক্ষণ ঘোষণা হওয়ার আগেই চলে এসেছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। চলতি বছর লোকসভা ভোটের জন্য
বাংলাতেই সবচেয়ে বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। ফেব্রুয়ারি
মাসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে পাঠানো চিঠিতে কমিশন জানিয়েছিল আসন্ন লোকসভা
ভোটে তারা বাংলায় ৯২০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে চায়। বিগত কয়েকটি
ভোটের পর্যালোচনা করেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে আর্জি জানিয়েছে কমিশন।
ভোট এবং ভোট পরবর্তী হিংসা বাংলাতেই সবচেয়ে বেশি এমনটাই দাবি কমিশনের। আর সে কথার
প্রমাণ দিচ্ছে তথ্যও। ভোট এবং ভোট পরবর্তী হিংসার ক্ষেত্রে দেশের নিরখে বাংলার
সামগ্রিক চিত্রটা একবার দেখে নেওয়া যাক।
আর কয়েকদিনের মধ্যেই দেশে হতে চলেছে
সাধারণ নির্বাচন। এই নির্বাচন সুস্থভাবে করার জন্য জাতীয় নির্বাচন কমিশন কোন
রাজ্যে কত কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রয়োজন তার একটা আর্জি জানিয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের
কাছে। সেই আর্জি অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের জন্য কমিশন ৯২০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী
চেয়েছে। যা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। এরপর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে
জম্মু-কাশ্মীরের নাম। জম্মু-কাশ্মীরে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করারনোর জন্য কেন্দ্রীয়
বাহিনী চেয়েছে ৬৩৫ কোম্পানী কেন্দ্রীয় বাহিনী। অন্যদিকে উত্তরপ্রদেশের জন্য চাওয়া
হয়েছে ২৫২ কোম্পানী, বিহার এবং ছত্তিশগড়ের জন্য চাওয়া হয়েছে যথাক্রমে ২৯৫ ও ৩৬০
কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। লোকসভা ভোটের পাশাপাশি অন্ধ্রপ্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ
ওড়িশা ও সিকিমে অনুষ্ঠিত হবে বিধানসভা নির্বাচনও। ফলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে
পাঠানো আর্জিতে নির্বাচন কমিশন অন্ধ্র ও ওড়িশার জন্য ২৫০ কোম্পানি কেন্দ্রীয়
বাহিনী চেয়েছে। অন্যদিকে অরুণাচল প্রদেশ ও সিকিমের জন্য চাওয়া হয়েছে ৭৫ ও ১৭
কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। ঝাড়খণ্ড ও পাঞ্জাবের জন্য চাওয়া হয়েছে ২৫০ কোম্পানি
বাহিনী। গোষ্ঠীহিংসায় বিধ্বস্ত মণিপুরের জন্য আর্জি জানানো হয়েছে ২০০ কোম্পানি
কেন্দ্রীয় বাহিনীর। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য বলে পরিচিত গুজরাটের জন্যও
চাওয়া হয়েছে ২০০ কোম্পানি বাহিনী।
কোন রাজ্যে কত কোম্পানি কেন্দ্রীয়
বাহিনী?
পশ্চিমবঙ্গে ৯২০ কোম্পানি
জম্মু-কাশ্মীরে ৬৩৫ কোম্পানি
ছত্তিশগড়ে ৩৬০ কোম্পানি
বিহাড় ২৯৫ কোম্পানি
উত্তরপ্রদেশে ২৫২ কোম্পানি
অন্ধ্রপ্রদেশ ও ওড়িশায় ২৫০ কোম্পানি
ঝাড়খণ্ড ও পাঞ্জাবে ২৫০ কোম্পানি
মণিপুর ও গুজরাটে ২০০ কোম্পানি
অরুণাচল প্রদেশে ৭৫ কোম্পানি
সিকিমে ১৭ কোম্পানি
গত লোকসভা ভোটে বাংলায় মোতায়েন করা
হয়েছিল ৭৪০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী। কিন্তু তারপরও বাংলার একাধিক জায়গায় ঘটেছে
ভোটের হিংসার ঘটনা। আর তা ছিল এতটাই বেশি যে বিরোধীদের দাবি মেনে এরপরে হওয়া
বিধানসভা ভোটে নির্বাচন কমিশন বাংলায় মোতায়েন করেছিল হাজার কোম্পানিরও বেশি
কেন্দ্রীয় বাহিনী। সাধারণত পঞ্চায়ে ও মিউনিসিপ্যালিটি ভোট হয় সাধারণ রাজ্য পুলিশ
দিয়ে। কিন্তু বিরোধীদের দাবি মেনে ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে গত পঞ্চায়েত ভোটে কলকাতা
হাইকোর্টের নির্দেশে প্রায় ৮০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল।
কেনো প্রতিটি ভোটেই বাংলায় মোতায়েন করা হয় এত কেন্দ্রীয় বাহিনী? বারে বারে দেখা
গেছে ভোট এলেই বাংলায় রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা বাড়ে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। অথচ
রাজ্য সরকারের দাবি বাংলায় রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা শূন্য। তথ্য লুকোচ্ছে রাজ্য সরকার
নাকি এর পেছনে রয়েছে অন্য কোনো কারণ, দেখে নেওয়া যাক একটু তথ্য প্রমাণ।
২০২২ সালে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড
ব্যুরো বা এনসিআরবির একটি রিপোর্ট বলছে বাংলায় একটিও রাজনৈতিক হত্যা হয়নি। রিপোর্ট
অনুযায়ী ২০২২ সালে পশ্চিমবঙ্গে মোট ১৬৯৬টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। যা ২০২০তে ছিল ১৯৪৮
এবং ২০২১ সালে ছিল ১৮৮৪টি। আর এই হত্যার পেছনে ছিল পণের দাবি। এনসিআরবির রিপোর্ট
অনুযায়ী ২০২২ সালে পণের দাবিতে বাংলায় ৩২২টি হত্যা হয়েছে। এছাড়াও নানা কারণে
বাংলায় হত্যার সংখ্যা ১১২৮টি। এর পাশপাশি আর্থিক লাভের জন্য ৫৫টি, ব্যক্তিগত
শত্রুতার কারণে ৭০টি, প্রেম ঘটিত বিবাদের জন্য ২৮টি, অবৈধ সম্পর্কে
১২টি, ডাকাতির কারণে
৫টি এবং নানান বিবাদে ১৫০টি হত্যা হয়েছে বাংলায়। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে ওই রিপোর্টে
দাবি করা হয়েছে, রাজনৈতিক কারণে বাংলায় একটিও হত্যা হয়নি। অথচ ঘটনাপ্রবাহ বলছে
অন্য কথা। তাহলে কী তথ্য চেপে যাচ্ছে রাজ্য সরকার? প্রসঙ্গত ২০২১
এবং ২২ সালের তথ্য গোপন করার অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর ২০২১
সালের তথ্য বলছে ওই বছর রাজ্যে ৩৪টি রাজনৈতিক হিংসা ও সেই সংক্রান্ত সাতটি খুনের
ঘটনা ঘটেছে। সে তথ্য নিয়েও সন্দেশ প্রকাশ করেছিলেন অ্যাক্টিভিস্ট বিশ্বনাথ
গোস্বামী। বিশ্বনাথবাবুর করা আরটিআই সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে রাজ্যে
৪০৭টি রাজনৈতিক হিংসা ও ৪৯টি রাজনৈতিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। বিশ্বনাথ গোস্বামী তথ্য
জানার অধিকার আইনে একটি মামলা করে অভিযোগ তুলেছিলেন যে বিভিন্ন সরকারি নথিতে
রাজনৈতি হিংসা ও মৃত্যুর সংখ্যায় গরমিল রয়েছে। বিভিন্ন জেলায় আরটিআই করে যে তথ্য
পেয়েছিলেন বিশ্বনাথবাবু, সেই অনুযায়ী ২০২১ সালে রাজ্যে ১,০১৭টি রাজনৈতিক
হিংসার ঘটনা ঘটেছিল, আর রাজনৈতিক হিংসায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ৬০ জনেরও বেশি মানুষ।
যদিও রাজ্যের সবকটি পুলিশ জেলা ও পুলিশ কমিশনারেট থেকে তথ্য দেওয়া হয়নি
বিশ্বনাথবাবুকে। দেওয়া হলে এই সংখ্যাটা নিশ্চিতভাবেই আরও বাড়ত। রাজ্য সরকারের তথ্য
লুকোনোর আরও বড় প্রমাণ হল, ২০২১ সালে কলকাতা হাইকোর্টে হিংসা নিয়ে একটি মামলায় রাজ্য
পুলিশের ডিজি আদালতকে জানিয়েছিলেন ২০২১ এ রাজ্যে রাজনৈতিক হত্যার সংখ্যা ছিল ২৯টি।
অথচ ওই বছরই রাজ্য সরকারের তরফে এনসিআরবিকে পাঠানো রিপোর্ট বলছে ২০২১ সালে রাজ্যে
রাজনৈতিক হিংসার সংখ্যা ৩৪টি ও মৃত্যু ৭টি। ২০২১ সালে এনসিআরবির ওই রিপোর্ট শুনে
বিজেপির মুখপাত্র দাবি করেছিলেন, ‘এসব কথা শুনলে রাস্তায় ইট, কাঠ, পাথরও হেসে
উঠবে। পঞ্চায়েত নির্বাচনকে রক্তাক্ত করল তৃণমূল’। শমীকবাবু আরও দাবি করেছিলেন, ২০২১ সালের ২
মের পরের ২৭দিনে রাজ্যে ৫৬জন বিজেপি কর্মী খুন হন। অথচ মুখ্যমন্ত্রী মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সময় দাবি করেছিলেন, দু-চারজন এদিক ওদিক মারা গিয়েছিল।
এবার প্রশ্ন হল এই যে নির্বাচন এলেই
বাংলায় হানাহানির ঘটনা ঘটছে তার পেছনে কারণটাই বা কি? এর জন্য দায়ী
কারা, কারাই বা হচ্ছেন
ক্ষতিগ্রস্ত? একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় এই হিংসার বদলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন
বাংলার গরিব মানুষ আর সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বাংলায় নির্বাচনী গণতন্ত্রের
ভাবমূর্তি। একটু তথ্য প্রমাণের দিকে নজর দিলেই দেখা যাবে বিগত বাম জামানায় থেকে
শুরু করে বর্তমান তৃণমূল জামানা আসলে কয়েনের এ পিঠ ও পিঠ। বাম জামানায় বাংলায় যত
রাজনৈতিক খুন হয়েছে, তৃণমূল জামানায় সেই ধারা তো কমেনি উল্টে বেড়েছে বেশ কয়েক গুণ।
একটু পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক।
বাংলায় বিভিন্ন নির্বাচনের আগে ও পরে
নির্বাচন নিয়ে সমীক্ষা করে অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস বা এডিআর। তাদের
একটি সমীক্ষা বলছে, ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের প্রার্থীদের ১৮
শতাংশের বিরুদ্ধে এবং নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীদের ৩৭ শতাংশের বিরুদ্ধে ছিল নানান
ফৌজদারী মামলা। যার মধ্যে বিজেপির ৩জনের বিরুদ্ধে, তৃণমূল
কংগ্রেসের ৩১ শতাংশ, সিপিএমের ৫০ শতাংশ এবং কংগ্রেসের ৫০ শতাংশ প্রার্থীদের বিরুদ্ধে
ছিল ফৌজদারী মামলা। ২০২১ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীকারী প্রার্থীদের ২৫
শতাংশের বিরুদ্ধে এবং জয়ী প্রার্থীদের ৪৯ শতাংশের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা ছিল। যার
মধ্যে ৪৩% প্রার্থী তৃণমূলের।
এ তো গেলো পরিসংখ্যানের বহর। বাংলায়
রাজনৈতিক হিংসা নতুন কোনো ঘটনা নয়। বরং বাংলায় ভোট আবহে হিংসার ধারা বজায় রয়েছে
সেই শুরু থেকেই। রাজনৈতিক হিংসার দিক থেকে দীর্ঘদিন ধরেই বাংলা দেশের মধ্যে প্রথম
স্থানে রয়েছে। বর্তমানের সন্দেশখালি হোক বা বছর দুয়েক আগের রামপুরহাট, ভোট এবং তার
আবহে সন্ত্রাস আর রাজনৈতিক খুনে দেশের সমস্ত রাজ্যকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে
বাংলা। সন্দেশখালি তো গত দেড় দু মাস ধরে খবরের শিরোনামে রয়েইছে, কিন্তু বাংলার
রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, রাজনৈতিক এই অত্যাচার বাংলায় প্রথম নয়, বরং এর চেয়েও
নগ্ন আর ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক হিংসার ছবি দেখেছে বাংলা। যার কিছু ঘটনা তো বাংলার
রাজনীতিতে চিরস্থায়ী কলঙ্কের ছাপ রেখে গেছে। আসুন একটু পেছনের দিকে ফিরে দেখা যাক।
বাংলার রাজনীতির ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস
রাজনৈতিক হিংসার নজির হিসেবে দেখা হয় সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ডকে। বাংলার গদিতে তখনও
পুরোপুরি ক্ষমতায় আসেনি বামেরা। রাজ্যে যুক্তফ্রন্ট সরকার। আর সেই সরকারের শরিক দল
সিপিএম। এক সময় বাংলায় প্রবল শক্তিশালী কংগ্রেস ততদিনে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে এসেছে।
বাংলায় কংগ্রেসের একমাত্র ভরসা তখন বর্ধমানের সাঁইবাড়ি। সিপিএমের গুন্ডাদের সামনেও
তখন মাথা উঁচু করে কংগ্রেসেই ভরসা রেখেছিল সাঁইরা। ১৯৭০ সালের ১৭ মার্চ বর্ধমানের
প্রতাপেশ্বর শিবতলা লেনে বাড়িতে ঢুকে খুন করা হয় সাঁই বাড়ির তিন সদস্যকে। মায়ের
সামনে ছেলেকে খুন করে, তার রক্ত দিয়ে মাখা ভাত খেতে বাধ্য করা হয় মাকে। সেদিন খুন হন
দুই ভাই প্রণব সাঁই ও মলয় সাঁই, খুন হন তাঁদের ঘনিষ্ঠ তথা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের
স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত ছাত্র জিতেন রায়ও। এই ঘটনার কিছুদিন পর শোকে অসুস্থ হয়ে
হাসপাতালে মারা যান প্রণব ও মলয়ের মা। এই ঘটনায় সেই সময় অভিযোগের তীর ছিল সিপিএমের
নিরুপম সেন, বিনয় কোঙারদের মত দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতাদের দিকে।
মরিচঝাঁপি গণহত্যা
পরিকল্পিতভাবে পুলিশ দিয়ে উদ্বাস্তুদের
খুন করেছিল সিপিএম। সম্ভবত বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের নৃংশতম গণহত্যাগুলির মধ্যে
তালিকার উপরের দিকে থাকবে মরিচঝাঁপি হত্যাকাণ্ড। ১৯৭৯ সাল। সদ্য ক্ষমতায় এসেছে
বামেরা। সেই সময় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি
দেশাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় দেড় লক্ষ উদ্বাস্তু দণ্ডকারণ্য হয়ে
সুন্দরবনের মরিচঝাঁপি দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সরকারি সাহায্য ছাড়াই ওই দ্বীপে
নিজেদের বসতি গড়ে তোলেন ওই উদ্বাস্তুরা। কেন্দ্র এবং রাজ্য কোনো সরকারই তাদের কোনো
স্বীকৃতি দেয়নি। ১৯৭৯ সালের ২৪ জানুয়ারি দ্বীপ থেকে উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদ করতে
পুলিশ পাঠায় জ্যোতি বসুর সরকার। রাজ্যের পুলিশ প্রায় ৩০ থেকে ৩৫টি লঞ্চ নিয়ে পুরো
দ্বীপটিকে ঘিরে ফেলে। জানুয়ারি মাসের ২৪ তারিখ থেকে ৩১ জানুয়ারি টানা ৮দিন ধরে চলে
হত্যালীলা। সেদিন ঠিক কত মানুষ মারা গেছিলেন সেই সংখ্যাটা আজও বের করা যায়নি।
প্রায় নির্জন হয়ে গিয়েছিল সুন্দরবনের ওই দ্বীপটি।
২১ জুলাই মহাকরণ অভিযান
১৯৯৩ সাল। বাংলায় তখন বামেদের
লালদুর্গের সূর্য মধ্যগগণে। ওই বছর ভোটারদের সচিত্র পরিচয়পত্রের দাবিতে রাজ্যের
বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ২১ জুলাই মহাকরণ অভিযান করেন
যুব কংগ্রেস কর্মীরা। কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় জড়ো হন রাজ্যের নানা জায়গা থেকে আসা
হাজার হাজার যুব কংগ্রেসকর্মী। ব্রেবোর্ন রোড ধরে মমতার নেতৃত্বে ওই কর্মীরা
মহাকরণের উদ্দেশ্যে অভিযান শুরু করে। সেই মিছিলে রাজ্যের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব
মণীশ গুপ্তের নির্দেশে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। গুলিতে নিহত হন ১৩জন যুব কংগ্রেস
কর্মী। আহতের সংখ্যা শতাধিক।
নানুর হত্যাকাণ্ড (Header)
বাংলার মসনদে সিপিএম হোক বা তৃণমূল, দুই জামানাতেই
বারে বারে রক্তে লাল হয়েছে লালমাটির দেশ বীরভূম। বিশেষ করে বীরভূমের নানুর ব্লক।
রাজ্যের সবচেয়ে পেছিয়ে পড়া এই ব্লকে মূলত ভূমিহীন, উপজাতি ও মুসলিমদের
বসবাস। ২০০০ সালের ২৭ জুলাই একটি বিতর্কিত জমিতে চাষ করা নিয়ে ভূমিহীন, রোজগারহীন
কৃষকদের উপর নির্বিচারে হামলা চালায় সিপিএম সমর্থকরা। মারা যান ১১জন তৃণমূল কর্মী।
এই ঘটনায় নড়ে গিয়েছিল গোটা বাংলার রাজনৈতিক মহল। জানা যায়, বীরভূমের
নানুরের সূঁচপুর গ্রামে সেদিন প্রকাশ্য দিবালোকে ১১জন প্রান্তিক চাষীকে কুপিয়ে
নৃশংসভাবে খুন করেছিল সিপিআইএমের তৎকালীন নানুর জোনাল সম্পাদক নিত্যনারায়ণ
চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ৪৪জন সিপিএম সমর্থক। ২০১০ সালের নভেম্বরে যাদের দোষী
সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিল সিউড়ি জেলা আদালত।
ছোট আঙারিয়া
প্রায় ২৩ বছর আগে অবিভক্ত মেদিনীপুরের
গড়বেতার এক অখ্যাত গ্রাম ছোট আঙারিয়া ভয়ঙ্কর এক রাজনৈতিক গণহত্যার কারণে উঠে
এসেছিল সংবাদের শিরোনামে। সেই সময় সদ্য জঙ্গলমহলে সংগঠন গড়ছে বাংলার নতুন রাজনৈতিক
দল তৃণমূল। ২০০১ সালের ৮ জানুয়ারি, ছোট আঙারিয়া গ্রামের তৃণমূল কর্মী
বক্তার মণ্ডলের বাড়িতে তৃণমূল সহ কয়েকটি বিরোধী দলের নেতারা বসেছিলেন এক গোপন
বৈঠকে। সেই মিটিংয়ে হঠাৎ করেই চড়াও হয় সিপিএম আশ্রিত কিছু দুষ্কৃতি। মোট ১১জন
তৃণমূল কর্মীকে সেদিন মেরে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছিল। পরে উদ্ধার হয় ওই মৃত ১১
জনের কঙ্কাল।
নন্দীগ্রাম (Header)
বাংলার রাজনীতির পট পরিবর্তন ঘটিয়েছিল
নন্দীগ্রাম। ২০০৭ সালে সিপিএম জামানায় জমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে
নন্দীগ্রামের মাটি। সেই সময় ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি, তৃণমূল, কংগ্রেস সহ
রাজ্যের বুদ্ধিজীবীরা একযোগে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তৎকালীন বাম সরকারের সিদ্ধান্তের
বিরুদ্ধে। ওই বছর নন্দীগ্রামে ঘটেছিল দুটি গণহত্যা। ওই বছর ১৪ মার্চ ভূমি উচ্ছেদ
কমিটির ‘মুক্তাঞ্চল’ দখলের সময় অভিযান চালায় পুলিশ। পুলিশের দলে পুলিশি পোশাকে
মিশেছিল সিপিএম আশ্রিত কিছু দুষ্কৃতি। তাদের তাণ্ডবে মারা যায় ১৪জন। আহত হন কয়েকশো
মানুষ। শুধু তাই হয় বহু মহিলাই শিকার হন গণধর্ষণের। এরপর ১০ নভেম্বর ভূমি উচ্ছেদ
কমিটির একটি মিছিলে গুলি চালায় ওই দুষ্কৃতিরা। মারা যান ১০ জন মানুষ। এই ঘটনাকেই
বাংলায় বাম জামানার পতনের সূত্রপাত বলে মনে করে থাকেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
নেতাই গণহত্যা (Header)
২০১১ সালের নেতাই গণহত্যা বাংলায়
সিপিএমের কবরে শেষ পেরেক পুঁতে দেয়। ওই বছর জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখ ঝাড়গ্রামের
নেতাইয়ে সিপিএমের এক নেতা মাওবাদী প্রতিরোধের নামে নিজের বাড়িতেই দুষ্কৃতিদের নিয়ে
তৈরি করেছিলেন সশস্ত্র শিবির। লক্ষ্য এলাকায় ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে বিরোধীদের উপর
চাপ তৈরি করা। কিন্তু ভয় না পেয়ে সরব হন এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা। যার ফলে
নেতাইয়ের ওই সিপিএম নেতার নির্দেশে দুষ্কৃতিরা গ্রামবাসীদের উপর নির্বিচারে গুলি
চালায়। মারা যান ৯জন নিরীহ গ্রামবাসী। আগুন জ্বলে ওঠে গোটা রাজ্যে। প্রতিবাদে মুখর
হয়ে ওঠে গোটা রাজ্য। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে নেতাইয়ের এই নৃশংস ঘটনাই বাংলায় বাম
শাসনের কফিনের শেষ পেরেক পুঁতে দিয়েছিল।
বগটুই গণহত্যা
২০১১-তেই শেষ হয়ে গিয়েছিল সিপিএমের ৩৪
বছরের শাসন। পরিবর্তনের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল সারা রাজ্যে। সাধারণ মানুষ ভেবেছিল এবার
বুঝি দিন পাল্টাবে। কিন্তু ২০১১ থেকে ২০২৪ এই ১৩ বছরে ছবিটা বদলায়নি তো বটেই উল্টে
হয়েছে আরও ভয়ঙ্কর। ২০২২ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঠিক আগে বীরভূমের লালমাটি
সাক্ষী থেকেছিল এক নৃশংস গণহত্যার। বীরভূমের বাতাসে ছেয়ে গেছিল মাংসের পোড়া গন্ধ
আর আতঙ্কিত মানুষের কান্না। তারিখটা ছিল ২১ মার্চ। বীরভূম জেলার রামপুরহাটের বগটুই
মোড়ে বোমা মেরে খুন করা হয় বড়শাল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ভাদু শেখকে। প্রতিশোধ
নিতে ওইদিন রাতেই ভাদু অনুগামীরা ১২টি বাড়িতে ঢুকে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
বাইরে থেকে আটকে দেওয়া হয় দরজা। আগুনে পুরে মৃত্যু হয় দশজনের। এই নৃশংস
অগ্নিকাণ্ডের মাস্টার মাইন্ড ছিল লালন শেখ। আজও রাতের বেলা সামান্য শব্দেও শিওরে
ওঠেন ওই এলাকার বাসিন্দারা।
ভোটের আবহেই হোক বা সারা বছর, পরিসংখ্যান বলছে
সমস্ত দেশের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ রাজনৈতিক হিংসা আর খুনের দিক থেকে দেশের মধ্যে
প্রথম স্থানেই রয়েছে। আর ভোট আবহের হিংসা নিয়ে তো অন্যান্য রাজ্যগুলিকে কয়েক ধাপ
পেছনে ফেলে দেবে বাংলা। কংগ্রেসী জামানা হোক, সিপিএম কিংম্বা বর্তমানের তৃণমূল
জামানা, বাংলায় ভোট
মানেই সংঘর্ষ, রক্ত আর খুনের রাজনীতি। লাল থেকে সবুজ বাংলায় রঙ বদলে গেলেও
রাজনীতির চরিত্র একই রয়ে গেছে। ফলে পেশির রাজনীতি আটকাতে নির্বাচন কমিশনকে বারে
বারেই দিতে হয় কড়া দাওয়াই। আর সেই দাওয়াইয়ের নাম কেন্দ্রীয় বাহিনী। স্বভাবতই আসন্ন
লোকসভা ভোট নিয়ে তাই আগাম সতর্ক জাতীয় নির্বাচন কমিশন। যে রাজ্যে ভোট মানেই খুন আর
সংঘর্ষের ইতিহাস, দেশের অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে সে রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী যে
বেশি মোতায়েন করবে কেন্দ্রীয় বাহিনী সে কথা বলাই বাহুল্য। অতএব আগামী ভোটেও বাংলার
অসুখের কড়া দাওয়াই তাই কেন্দ্রীয় বাহিনীই।