প্রায় দেড় মাস নিখোঁজ থাকার পর গ্রেফতার
হয়েছিলেন সন্দেশখালি কান্ডের প্রধান অভিযুক্ত শেখ শাহজাহান গ্রেফতার হয়েছিলেন।
রেশন দুর্নীতি থেকে তার দলবলকে দিয়ে ইডির উপর হামলা থেকে সরকারী সম্পত্তি ভাঙচুর,
সন্দেশখালির ‘বাঘ’ এর নামে একাধিক অভিযোগ ছিল। রাজ্য পুলিশের হাত
থেকে শেখ শাজহানের কেস এরপর যায় সিবিআইএর হাতে। রাজ্য পুলিশের উপর ভরসা রাখতে
পারেনি উচ্চ আদালতও। তারা সরাসরি শাহজাহানকে সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ
দেয়। রাজ্য পুলিশের হাতে থাকার সময় শেখ শাহজাহানকে দেখে একবারু মনে হয়নি গুরুতর
অপরাধে তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। বরং তার আচরণ দেখে মনে হয়েছিল পুলিশ তাকে নয় বরং
তিনিই পুলিশকে গ্রেফতার করেছেন। কিন্তু সিবিআইয়ের হাতে সমপর্ণের পরই ছবিটা একদম
বিপরীত দেখা গিয়েছিল। সন্দেশখালির বাঘ, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী
সংস্থার হাতে পড়ে ক্রমশ বেড়ালে পরিণত হয়েছেন।
খুব সাধারণ এক ব্যক্তি থেকে শাহজাহান কীভাবে
সন্দেশখালির বাঘ হয়ে উঠেছিলেন সেই প্রশ্ন অনেকেরই মনে থেকে গেছে। তৃণমূল জামানায়
সন্দেশখালিতে শেখ শাহজাহানই ছিলেন শেষ কথা। তার নির্দেশ ছাড়া সেখানকার গাছের পাতাও
নড়ত না। মহিলা নির্যাতন থেকে শুরু করে জমি দখল, কোনো অপরাধই
করতে বাকি ছিল না এই তৃণমূল নেতার। দীর্ঘদিন ধরেই শাহজাহানের উত্থান হচ্ছিল উল্কার
গতিতে। স্থানীয় প্রশাসন থেকে রাজ্যের শাসক দল সব জানলেও চোখ বুজে ছিল। কিন্তু
প্রথমে ইডির হানা, এরপর ইডি অফিসারদের উপর হামলার ঘটনার পর
থেকেই শাহজাহান নামক অপরাধের অন্ধকার জগত থেকে উঠতে শুরু করে পর্দা। কীভাবে উত্থান
হল তাঁর?
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি,
বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে এ রাজ্যে প্রবেশ ঘটেছিল
শাহজাহানের। কারও কারও দাবী সিপিএম জামানায় শাহজাহানকে রাজ্যে অনুপ্রবেশ
করিয়েছিলেন তদান্তীন সিপিএম নেতা নিরাপদ সর্দার। সূত্র অনুযায়ী শাহজাহানের স্কুল
ছাড়ার কাগজ মতে তার স্কুল বাংলাদেশে। শুধু তাই নয় বাংলাদেশে কলেজে পড়াকালীন
সন্দেশখালির এই নেতা ছিলেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল বিএনপির সক্রিয় নেতা এবং কর্মী।
প্রসঙ্গত বাংলাদেশে বিএনপি উগ্রপন্থী উগ্র মৌলবাদী সংগঠন হিসেবে পরিচিত। ২০০৩ সাল
থেকে সন্দেশখালিতে শাহজাহানের উত্থান শুরু হয় সন্দেশখালিতে। ২০০৪ সালে সিপিএম
জামানায় তাঁর মামা তথা সিপিএম নেতা সোমলেম শেখের হাত ধরে বাংলার রাজনীতিতে প্রবেশ
শাহজাহানের। সেই সময় এ দেশের ভোটার কার্ড থেকে রেশন কার্ড শাহজাহানের সমস্ত নথিরই
ব্যবস্থা করেছিল সিপিএম। কারণ সিপিএম জামানার শেষ ১২ বছর সন্দেশখালির আতঙ্ক ছিলেন
মোসলেম শেখ। প্রথম জীবনে সন্দেশখালিতে ট্রেকারের হেল্পার হিসেবে কাজ শুরু করেন
শাহজাহান। এরপর ২০০২ সালে শুরু করেন ইটভাটার শ্রমিক হিসেবে কাজ। এরপর ২০০৪ এ
শাহজাহান যোগ দেন সিপিএম। দলে এসেই শাহজাহান সরবেরিয়ার বিভিন্ন বুথে সিপিএম এর হয়ে
ভোট করানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। সেখান থেকেই শুরু শাহজাহানের অত্যাচারের
কাহিনী।
বামফ্রন্ট জামানায় রাজনীতিতে প্রবেশ করে
শাহজাহানের অভূতপূর্ব উত্থান হয় তৃণমূল জামানায় এসে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে,
যেভাবে সিপিএম জামানায় সন্দেশখালিতে ভেরির রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন
মজিদ মাস্টার, ঠিক সেভাবেই তৃণমূল জামানায় মোসলেম আর
শাহজাহানের মামা-ভাগ্নে জুটি কাজ শুরু করে। ২০০৮ সালে রাজ্যে পরিবর্তনের হাওয়া
বুঝে শাহজাহান সিপিএম পার্টির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতে শুরু করেন। এরপর ২০১০ সাল
থেকেই একেবারে বামফ্রন্টের হাতের বাইরে চলে যান তিনি। তারপর তৃণমূল জামানায় মামার
ছায়া থেকে বেরিয়ে একাই সন্দেশখালির বাঘ হয়ে ওঠেন তিনি।
গ্রেফতারের পর রাজ্য পুলিশের হাতে থাকায় শেখ
শাহজাহানের দাপট দেখা গিয়েছিল প্রবল। কারণ তিনি জানতেন তার মাথায় হাত রয়েছে
রাজ্যের শাসক দলের। কিন্তু ইডির অভিযোগের পর এই মামলা উচ্চ আদালতে গেলে,
আদালতের রায়ে শাহজাহানকে সিবিআইয়ের হাতে সমর্পণ করা হয়। এরপরই
শাহজাহান বুঝে যান রাজ্য সরকার যতই তার পেছনে থাকুক, কেন্দ্রীয়
তদন্তকারী সংস্থা রাজ্যপুলিশের মতো তাকে জামাই আদর করবে না। ফলত ধীরে ধীরে বাঘের
খোলস ছেড়ে বেড়াল হতে শুরু করেন তিনি। তবে তার মধ্যেও ঠিক কতটা ক্ষমতাশালী শাহজাহান
তার টের পাওয়া যাচ্ছে। গত ২৩ মার্চই অভিযোগ উঠেছিল শাহজাহান সিবিআইয়ের হাতে বন্দী
হলেও তার লোকজন এখনও ভয় দেখাচ্ছে স্থানীয়দের। সেই হুমকী নিয়ে চলতি মাসের ২৩
তারিখেই উত্তপ্ত হয়েছিল জেলিয়াখালি অঞ্চল। ওইদিন আদালতের অনুমতি নিয়ে সন্দেশখালির
চারটি পঞ্চায়েত এলাকায় গিয়েছিলেন বিজেপির রাজ্য মহিলা মোর্চার সভাপতি ফাল্গুনি
পাত্র এবং প্রাক্তন আইপিএস তথা বিজেপি নেত্রী ভারতীয় ঘোষ। সেই সময় শাহজাহানের
অনুচরদের হুমকির কথা তাঁদের জানান স্থানীয়রা।
দুই বিজেপি নেত্রীকে হাতের সামনে পেয়ে
সন্দেশখালির মহিলারা অভিযোগ করেন এখনও তাদের ভয় দেখাচ্ছে শাহজাহান বাহিনী। শুধু
তাই নয়,
শাহজাহান এখনও কতটা ক্ষমতাশালী তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে গত ২৫
মার্চও। ২০১১ সালে রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর প্রায় ১ একর ১৫ শতক জায়গা দখল
করে শাহজাহান নিজের নামে একটি বাজার তৈরি করেছিলেন সন্দেশখালিতে। পুলিশের হাতে
গ্রেফতার হওয়ার পর এই বাজার থেকে তৃণমূলের দলীয় পাতাকা সরিয়ে দিয়েছিলেন স্থানীয়রা।
কিন্তু গ্রেফতারের মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই সেই বাজারেই আবারও তৃণমূলের পতাকা
লাগিয়ে দিল শাহজাহানের অনুগামীরা। এর থেকেই শাহজাহানের ক্ষমতার আন্দাজ পাওয়া যায়।
যদিও সিবিআইয়ের আধিকারিকদের মতে, ধীরে ধীরে ভাঙছেন শাহজাহান।
আচমকাই তার বিবেক জেগে উঠেছে। তিনি জেরায় জানিয়েছেন, সন্দেশখালিতে
ইডির উপর যে হামলা হয়েছিল তা একেবারেই অনুচিত কাজ হয়েছে। তবে সিবিআই দাবি করেছে
ইডির উপর হামলার ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত। কারণ যেভাবে ইডি হানার পর দ্রুততার সঙ্গে
শাহজাহান অনুগামীরা ইট, লাঠি নিয়ে জড়ো হয়েছিলেন তা পরিকল্পনা
ছাড়া সম্ভব ছিল না বলে দাবি সিবিআইয়ের।
কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দাবি,
ইডির উপর হামলার পর গাড়িতে যে ইট পাওয়া গিয়েছিল তাতে লেখা ছিল
‘এসকেএসটি’। শাহজাহানের ইটভাটার ইটও ওই নামেই বিক্রি করা হয়। যার ফলে কেন্দ্রীয়
তদন্তকারী সংস্থা দাবি করছে সেদিন হামলা করতে শাহজাহান নিজের ইটভাটা থেকে প্রায়
পাঁচ হাজার ইট মজুত রেখেছিল। তবে কেন্দ্রীয় বাহিনীর হাতে সন্দেশখালির বাঘ গ্রেফতার
হলেও, এখনও তার অনুগামীরা এলাকা দখলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
যা থেকে শাহজাহানের ক্ষমতার আন্দাজ করা যেতে পারে।